ডাকসু জিএস হয়ে বাবলু যে কাণ্ডে আলোচিত

বাংলাদেশের রাজনীতি এবং ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঘটনায় আলোচিত হয়ে থাকবেন জিয়াউদ্দিন বাবলু।

সাজিদুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Oct 2021, 08:58 AM
Updated : 2 Oct 2021, 09:18 AM

গত শতকের ৮০ এর দশকে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের দলে ভিড়ে গিয়ে ব্যাপক সমালোচিত হন তিনি।

নানা সুবিধা নিয়ে তার সেই পদক্ষেপকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বললেও সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ক্ষতি হয়নি বলে মনে করেন তৎকালীন ছাত্রনেতারা।

প্রবল আন্দোলনেই ১৯৯০ সালে পতন ঘটে এরশাদের, আর তখনও ছাত্র আন্দোলনের নেতারাই ছিলেন মূল প্রভাবকের ভূমিকায়।

সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলেও বাবলু জাতীয় পার্টিতে এরশাদের বিশ্বস্ত হয়েই ছিলেন। এই দলটির মহাসচিব পদে থাকা অবস্থায়ই শনিবার মারা যান তিনি।

আশির দশকে তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ যখন রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিলেন, তখন তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদটি এসেছিল শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকেই। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু।

১৯৮২ সালের সেই ডাকসুতে সভাপতি ছিলেন মো. আখতারুজ্জামান (বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা)। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জিয়াউদ্দিন বাবলু।

তৎকালীন ছাত্রনেতারা বলেন, সেই ডাকসুর আগে দুইবার ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে জিএস ছিলেন আখতারুজ্জামান। তাদের যে জনপ্রিয়তা বা প্রভাব ছিল, তা বাবলুর না থাকলেও তখন প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠন বাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ডাকসুরও জিএস নির্বাচিত হন ইংরেজি বিভাগের ছাত্র বাবলু।

এইচ এম এরশাদের সঙ্গে জিয়াউদ্দিন বাবলু। ফাইল ছবি

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এরশাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন পেরুনোর পরই বাবলু সেই কাণ্ড ঘটান।

কী ঘটেছিল তখন- জানতে চাইলে তখনকার ডাকসুর সদস্য এবং বর্তমানে বাসদ নেতা বজলুর রশিদ ফিরোজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এরশাদের বাহিনী ক্যাম্পাসে ম্যাসাকার করল। জাফর, জয়নালরা শহীদ হলেন। পুলিশ-আর্মি শত শত ছাত্রকে গ্রেপ্তার করল, জখম করল।

“এরকম পরিস্থিতিতে সূর্যসেন হলের হাউজ টিউটরের বাসা থেকে বাবলু তার বন্ধু এক মেজরের গাড়িতে করে পালিয়ে যায়। বাবলু ওই হলের আবাসিক ছাত্র ছিল। আর্মির গাড়িতে তার চলে যাওয়া, এটাকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে দেখা হল। কারণ সে ছিল ডাকসুর জিএস।”

ফিরোজ বলেন, “যখন ছাত্ররা মার খাচ্ছে, মারা গেছে, তখন ভীরুর মতো আর্মির গাড়িতে এভাবে সে পালাতে পারে না। একটা মিটিংয়ে সে এটা এগ্রিও করে। তখন ডাকসুর জিএস পদ থেকে একটা অব্যাহতিপত্র তার কাছ থেকে নেওয়া হয়। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

“এর কিছুদিন পরও সে দলের সঙ্গে ছিল। একটা পর্যায়ে এরশাদের চার দফা বাস্তবায়ন পরিষদ করে। তখন তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে বাবলু নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ করে।”

ছাত্র আন্দোলনে জেরবার এরশাদ ছাত্রদের মধ্যে তার অবস্থান তৈরিতে নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ নামে একটি সংগঠন গড়েছিলেন। পরে নাম বদলে তা হয় জাতীয় ছাত্র সমাজ। কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে এরশাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি।

এদিকে বাবুলকে ১৯৮৪-৮৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা করেন এরশাদ, উপসচিবের মর্যাদায়। ১৯৮৫-৮৬ সালে তাকে শিক্ষা উপমন্ত্রী করেন এরশাদ।

এরপর ১৯৮৬-৮৭ সালে বাবলুকে করা হয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী। ১৯৮৭ সালে হন অর্থ প্রতিমন্ত্রী। ওই বছরই বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে তাকে পূর্ণ মন্ত্রী করেন এরশাদ। পরে পেয়েছিলেন জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা, ওই সময়কার বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নূর আহমেদ বকুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এরশাদের সবসময়কার টার্গেট ছিল ছাত্র আন্দোলনকে দ্বিখণ্ডিত করা। শেষ দিন পর্যন্ত সে এই কাজ করে। ওই সময় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে রাজনীতিতে ঢোকানো, এসব করেছে।

“ওই সময় বাবলুর চলে যাওয়াটা ছিল সেই সময়কার রাজনীতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। এরশাদ আন্দোলন ভাঙতে চেয়েছিল, বাবলু সেখানে সহায়তা করেছে। এরপরে এরশাদকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বাবলু।”

তবে বাবলুর চলে যাওয়া ছাত্র আন্দোলনে ভাঙন ধরাতে কিংবা গতি কমাতে কোনো ভূমিকা রাখেনি, বলেন বকুল।

বর্তমানে ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর এই সদস্য বলেন, “বাবলু ব্যক্তি জীবনে সজ্জন ছিলেন। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির সঙ্গেই ছিলেন। রাজনৈতিক আত্মহত্যাটা বাবলু ওই সময়টাতেই করেছে।

“যদিও বাবলুর চলে যাওয়ায় খুব একটা কাজ হয়নি। কারণ ছাত্র আন্দোলন তখন জোরদার। সংগঠনগুলো জোটবদ্ধ হয়ে লড়ছে।”

ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থীদের ২০১৮ সালের পুনর্মিলনীতে সস্ত্রীক জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। ফাইল ছবি

জিয়াউদ্দিন বাবলুর জন্ম ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে। ইংরেজিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবিও সম্পন্ন করেন।

১৯৮৮ সালে প্রথম সংসদ সদস্য হন বাবলু। ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে নির্বাচনকালীন সরকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা করা হয়েছিল তাকে।

২০১৪ সালে (চট্টগ্রাম-৯) আসন থেকে দশম জাতীয় সংসদের সদস্য হন বাবলু। একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হতে চাইলেও জোট রাজনীতির কারণে এরশাদের অনুরোধে তিনি ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ান।

২০১৪ সালে এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে এরশাদ জাতীয় পার্টির মহাসচিব করেন বাবলুকে। ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সেই দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

এরপর পরে ২০২০ সালের জুলাই মাসে মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁকে সরিয়ে বাবলুকে আবার সেই পদে ফিরিয়ে আনেন এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসা জি এম কাদের।

জিয়াউদ্দিন বাবলুর প্রথম স্ত্রী অধ্যাপক ফরিদা আক্তার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০৫ সালে মারা যান। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে।

২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল এরশাদের ভাগ্নি মেহেজেবুন্নেসা টুম্পাকে বিয়ে করেন বাবলু। ড. আসাদুর রহমান ও মেরিনা রহমানের মেয়ে টুম্পাও বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেন।

বাবলু ফার্স্ট কমিউনিকেশন লিমিটেড ও হাইটেক ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্টারন্যাশনাল নামে দুটি প্রতিষ্ঠানেরও চেয়ারম্যান ছিলেন।