জিয়ার লাশ নিয়ে বিতর্ক সংসদেও

ঢাকার চন্দ্রিমা উদ্যানের সমাধিতে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সমারিক শাসক জিয়াউর রহমানের লাশ থাকা না থাকা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে সংসদে।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Sept 2021, 09:38 AM
Updated : 16 Sept 2021, 09:38 AM

বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশ জাতীয় আরকাইভস বিল, ২০২১’ বাছাই কমিটিতে পাঠানো ও সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনার সময় জিয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির এমপিরা।

বিএনপির সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন প্রথম বিষয়টি তোলেন। বিএনপি ও জাতীয় পার্টির এমপিরা বক্তব্য পাল্টা বক্তব্য দেন। পরে সাংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ জিয়ার লাশ থাকার বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের প্রস্তাব দেন।

পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, “সেখানে কোনো লাশ নেই তা ৪০ বছর আগেই প্রমাণিত। একটি বাক্স রয়েছে।”

ওই বাক্স সরিয়ে ফেলার দাবি তুলে শেখ সেলিম বলেন, “লাশ থাকলে তার স্ত্রী সন্তানকে দেখানো হয়নি কেন? তখন ক্ষমতায় থেকেও বিএনপি লাশ থাকার প্রমাণ দিতে পারেনি। যদি লাশ থেকে থাকে, আগামী এক মাসের মধ্যে প্রমাণ দিতে হবে।”

ভবিষ্যতে সংসদে লাশ নিয়ে কোনো কথা যাতে না হয়, সেই ব্যবস্থা নিতে স্পিকারকে অনুরোধ করেন শেখ সেলিম।

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সেনাবাহিনীর একদল সদস্যের অভ্যুত্থানে নিহত হন সে সময় রাষ্ট্রপতি পদে থাকা জিয়াউর রহমান। ঘটনার আগের দিন স্থানীয় বিএনপি নেতাদের বিরোধ মেটাতে চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন তিনি।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর গত নবম ও দশম জাতীয় সংসদের একাধিক বৈঠকে জাতীয় সংসদ এলাকা থেকে জিয়ার কবরসহ লুই আই কানের নকশাবহির্ভূত সব স্থাপনা সরানোর বিষয়ে কথা ওঠে।

তখন বিএনপির পক্ষ থেকে প্রবল আপত্তি তোলা হয়েছিল। তবে ওই আলোচনা এক সময় স্তিমিত হয়ে পড়েছিল।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বক্তৃতায় বলেন, ওই কবরে জিয়ার লাশ নেই। এর পর জিয়ার লাশ নিয়ে আবার সরব হয় রাজনৈতিক অঙ্গন।

আরকাইভস বিল বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাবের আলোচনাকালে বিএনপির সদস্য মোশারফ হোসেন বলেন, “জিয়াউর রহমানের লাশ সেখানে (চন্দ্রিমা উদ্যান) আছে কি নাই, সেটা বড় বিষয় নয়। সেখানে যে লাশ নাই, তা আপনারা (আওয়ামী লীগ) কীভাবে জানলেন? এতবছর ধরে ক্ষমতায় আছে। এটা নিয়ে আগে তো কথা বলেন নাই কেন? এখন কেন বলছেন?”

জাতীয় পার্টির শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “ইতিহাস বিকৃতিতো বিএনপিও করে। তারা বলেন স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান। এ বিষয়ে আমাদের সুপ্রিম কোর্টের নির্দশনা রয়েছে। আর তিনি (জিয়াউর রহমান) বেঁচে থাকতে কখনোই বলতে শুনেনি, দেখিনি উনি নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেছেন। তাদের প্রথমে ইতিহাস বিকৃতি বন্ধ করতে হবে। তারপর আওয়ামী লীগ যদি ইতিহাস বিকৃতি করে থাকে, সেটা বন্ধের আহ্বান বিএনপি জানাতে পারে।”

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, “সংসদ ভবন নিয়ে লুই কানের যে নকশা, সেখানে কোথায় রয়েছে যে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের লাশ দাফন করতে হবে? সেখানে লাশ আছে কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেগম জিয়া স্বামী মনে করে কাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানান?

“তারই উচিত এই প্রশ্ন করা, উনার স্বামীর লাশ সেখানে আছে কিনা? বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে তারই নির্ণয় করা উচিত। আপনারা দলের নেতা ভেবে কাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। ওখানে কি কারো মৃতদেহ আছে? নাকি অন্য কারো মৃতদেহ আছে।”

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী বলেন, “একজন বলেছেন, সঠিক ইতিহাস আসতে নাকি শতবছর লাগে। মৃত্যুর ৪০ বছর পরে সঠিক ইতিহাস বের হলে সমস্যা কোথায়? জিয়াউর রহমানের লাশ আছে কি নাই, এটা বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণের ব্যবস্থা আছে। আপনারা (বিএনপি) নিরপেক্ষ একটা কমিটি করেন। সরকার সহযোগিতা করবে। সত্য উদঘাটনে ভয়ের কি আছে?”

তিনি বলেন, “আপনাদের দলের নেত্রীকে বলেন, যদিও তিনি সাজাপ্রাপ্ত। প্রধানমন্ত্রীর অনুকম্পা নিয়ে সাজা স্থগিত নিয়ে বসবাস করছেন। আইনের সুযোগ থাকলে তার নেতৃত্বে কমিটি করেন।”

বিএনপি হারুনুর রশীদ বলেন, “সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ তার বক্তব্যে চন্দ্রিমা উদ্যানে জিয়াউর রহমানের লাশ থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ১৯৭৯ সালে সংসদ ছিল। সেখানে আওয়ামী লীগও ছিল। মানিক মিয়া এভিনিউয়ে যে জানাজা হয়েছিল, তাতে সংসদ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। শোক প্রস্তাবের উপর সংসদে দীর্ঘ আলোচনায় তারা অংশ নিয়েছিলেন। সেগুলো প্রসিডিংসের মধ্যে রয়েছে। আমার কথায় যদি কোনো অপ্রাসঙ্গিক বিষয় থাকে, তা এক্সপাঞ্জ করুন।”

তিনি বলেন, “কারো যদি অপমৃত্যু হয়। তাহলে তার ময়নাতদন্ত লাগে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। সামরিক আদালতে বিচারও হয়েছে। এটা অসত্য কিছু নয়। আজকে জেনারেল এরশাদ বেঁচে থাকলে তিনি লজ্জা পেতেন। লজ্জা পেয়ে মুখ ঢাকতেন।”

বিএনপির রুমিন ফারহানা বলেন, “আরকাইভস যদি করতে হয়, তাহলে স্বীকার করতে হবে জিয়াউর রহমান ছিলেন রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ছিলেন বীর উত্তম, এটা স্বীকার করেতে হবে। তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। উনারা উনাদের কথা বলবেন। আর আমরা আমাদের কথা। এইটুকু ধৈর্য্য যদি তাদের না থাকে, তাহলে তারা কী ইতিহাস লিখবে? চর্চা করবে? আরকাইভসে কী জমা হবে সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছি।”

রুমিন বলেন, “ইতিহাস সবসময় জয়ীদের হাতে লেখা হয় বলে। তাই আমাদের মত দেশে প্রকৃত ইতিহাস জানতে শতবছর লাগে। যতদিন পর্যন্ত দলীয় চশমায় ইতিহাস লেখা হয়, তাতে আইন পাস করে কোনো লাভ হবে না। আজকে ৪০ বছর পরে কেন জিয়াউর রহমানের কবর নিয়ে এই বিতর্ক। সরকারের ব্যর্থতা, ভোট চুরি, গণতন্ত্রহীনতা, লুটপাট থেকে মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য এই বিতর্ক করা হচ্ছে।”

রুমিন ফারহানার বক্তব্যের শেষ দিকে সংসদে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সরকার দলীয় সদস্যরা হইচই করেন।                                                                                                      

আইন প্রণয়ন কার্যাবলী শেষে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, “আজ ৪০ বছর পর লাশ নিয়ে লাফালাফি করা হচ্ছে। সংসদ ভবন এলাকায় জিয়াউর রহমানের লাশ রয়েছে বিএনপির এমপিরা তা সংসদে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেখানে যে জিয়াউর রহমানের লাশ নেই সেটা ৪০ বছর আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছে।”

তিনি বলেন, “জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর তার লাশ পরিবারের কেউ দেখেননি। খালেদা জিয়া দেখেননি। তারেক জিয়া লাশ দেখার জন্য কান্নাকাটিও করেছিলেন। শাহ আজিজ একটি চালাকি করেছিলেন। ‘লাশ পাওয়া যাক না যাক, একটা বাক্স পাঠিয়ে দাও’। সেই বাক্স পাঠানো হয়েছিল। জনমনে সন্দেহ ছিল কিসের জানাজা করছি। শুধু বাক্স? নাকি ওখানে জিয়াউর রহমান আছে?”

সেই সময়ের এক অধিবেশনের কথা স্মরণ করে সেলিম বলেন, “২০ জুন ১৯৮১ সালে আমি সংসদের নতুন সদস্য। জিয়াউর রহমান তখন মারা গেছেন। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। সংসদে আমি সরকারের কাছে এটা জানতে চেয়েছিলাম। এটা প্রসিডিংসে আছে। আমি সেদিন বলেছিলাম, আপনারা প্রমাণ করেন। ওই বাক্সে কোনো লাশ আছে কি না। জনমনে সন্দেহের কথা সেদিন সংসদে বলেছিলাম।

“আমি দুই দিনের মধ্যে লাশের ছবি ছাপিয়ে জনমনের সন্দেহ দূর করতে বলেছিলাম। আর না পারলে জনমনের সন্দেহ-ই প্রমাণিত হবে। আজ ৪০ বছরেও একখানা ছবি দেখাতে পারেননি। প্রমাণই করতে পারেননি। একখানা বাক্স দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছেন। একটা বাক্স এনে বলেছেন জিয়াউর রহমন লাশ। এই বিভ্রান্তি দূর হয়ে গেছে। ওখানে যে বাক্সটা আছে তা সরিয়ে লুইকানের নকশা বাস্তবায়ন করতে হবে।”

স্পিকার শিরীন শারমিনের উদ্দেশে এই সাংসদ বলেন, “সেখানে বাক্সটা যদি থাকে তা সরিয়ে দেন। জিয়ার লাশ জায়েজ করার জন্য তিন বড় রাজাকারকে সংসদ ভবন এলাকায় কবর দেওয়া হয়েছে। তাদের করবও সেখান থেকে সরিয়ে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। মানুষ এসব বিভ্রান্তি মেনে নেবে না।”

বিএনপি নেতাদের উদ্দেশ্য করে সেলিম বলেন, “সংসদে কোন বক্তৃতা দেয়ার ইস্যু পেলেই জিয়াউর রহমানের লাশ। এখানে লাশ আছে প্রমাণ করেন। এক মাস সময় দিলাম। ওই সময় সেনাপ্রধান এরশাদ সাহেবও লাশ দেখেননি। তাহলে কী দিয়ে প্রমাণ করবেন? লাশ নিয়ে আর রাজনীতি করিয়েন না। ওখানে কোনো লাশ নেই। কিছুই নেই।”

তিনি বলেন, “দুই নম্বর রাজনীতি বহু করছেন। বাংলাদেশের মানুষ আপনাদের চিনেছে। আর দুই নম্বর রাজনীতি কইরেন না। জিয়াউর রহমান যে অপকর্ম করেছেন, তার পরিণতিতে দেখেন আপনাদের কী হয়। লাশ নিয়ে যেন কথা বলার সুযোগ না দেওয়া হয়।”