জাতীয় পার্টিতে কোন দিশা খুঁজছেন বিদিশা?

এইচ এম এরশাদের সঙ্গে বিয়ের সূত্রে জাতীয় পার্টিতে পদ নিয়ে সক্রিয় হয়েছিলেন বিদিশা, কিন্তু বিচ্ছেদের পর হারিয়ে যান দল থেকেও। এখন সন্তানের সূত্রে আবার জাতীয় পার্টিতে ঢুকতে চাইছেন তিনি।

সাজিদুল হক নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Sept 2021, 04:39 AM
Updated : 7 Sept 2021, 05:45 AM

বিদিশার নতুন প্রয়াসে ‘স্তিমিত’ বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মধ্যে নড়াচড়া শুরু হয়ে গেছে। দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে বলে জানালেন বিদিশা।

এতে দলটিতে আবার ভাঙনের গুঞ্জন ছড়ালেও বিদিশাকে নিয়ে কোনো ‘মাথাব্যথা’ নেই বলেই জানালেন এরশাদের ভাই জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

সেনাপ্রধান থেকে ক্ষমতা দখল করে এরশাদ যে জাতীয় পার্টি গড়েছিলেন, তা তিন যুগে তিন বার ভেঙেছে। তবে এরশাদ নেতৃত্বাধীন অংশ বরাবরই শক্তিশালী থেকেছে।

ক্ষমতাচ্যুত এরশাদকে ২০০০ সালে বিয়ে করেন কবি আবু বকর সিদ্দিকের মেয়ে বিদিশা সিদ্দিক। সন্তান শাহতা জারাব এরিকের জন্মের পর সেই সংসার টুটে যায় ২০০৫ সালেই।

তখন এরশাদের দেওয়া চুরির মামলায় জেলেও যেতে হয়েছিল বিদিশাকে। আইনি লড়াই চালিয়ে এরিককে নিজের কাছে রাখেন এরশাদ।

দুই বছর আগে এরশাদের মৃত্যুর পর তার বাড়ি বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে উঠে পড়েন বিদিশা। তার ছেলে এরিককে ‘চরম অবহেলা করে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটানো হয়েছে’ বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

মাস দুয়েক আগে এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে এরিক জাতীয় পার্টির ‘নতুন কমিটি’ ঘোষণা করেন; যদিও তাকে রাজনীতি থেকে দূরেই রেখেছিলেন এরশাদ, আর দলেও তার কোনো পদ নেই।

এরিক তার সৎ মা সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে ‘নতুন কমিটি’র চেয়ারপার্সন ঘোষণা করেন। মা বিদিশার সঙ্গে রওশনের ছেলে রাহগীর আল মাহি সাদকে (সাদ এরশাদ) কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন তিনি। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে ঘোষণা করা হয় এরশাদ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান কাজী মামুনুর রশীদের নাম।

দুই মাস আগে এই অনুষ্ঠানেই এরিক জাতীয় পার্টির ‘নতুন কমিটি’ ঘোষণা করেন।

গত ১৪ জুলাই এরিকের সেই ঘোষণার পরপরই জাতীয় পার্টি জানায়, রওশন জাতীয় পার্টির চেয়ারপার্সন হতে চান না। এরশাদের মৃত্যুর পর রংপুরে তার আসনের এখনকার সংসদ সদস্য সাদ সরাসরি কোনো বক্তব্য দেননি।

এরপর দুই মাসে আর কোনো খবর না এলেও ‘নতুন কমিটি’ সংশ্লিষ্ট কয়েকজন নেতা বলেছেন, বিদিশার লক্ষ্য আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। আর সে লক্ষ্যেই তিনি, বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন পুরনো নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। জাতীয় পার্টিরও জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতাও তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির এক জ্যেষ্ঠ নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিদিশা সিদ্দিকের নতুন কমিটি ঘোষণার পর পদবঞ্চিত এবং বহিষ্কৃত অনেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এখন পদে আছেন এমন অনেকেই যোগাযোগ রাখছেন।

“তবে প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলতে চাইছেন না। কারণ প্রকাশ্যে বললেই দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”

জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উত্তরের বিভিন্ন জেলার পদবঞ্চিত নেতা-কর্মীদের সাথে বিদিশা যোগাযোগ করছেন বলে জানি। কেন্দ্রেরও অনেকে তার সাথে যোগাযোগ করছেন। আর তিনিও যোগাযোগ করছেন।”

কী বলছেন বিদিশা?

বিদিশার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি পুরোমাত্রায় জাতীয় পার্টিতে যুক্ত হতে চাইছেন, আর একে তিনি বলছেন ‘দল পুনর্গঠন’।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেখুন আমি কিন্তু কোনো পার্টি ঘোষণা করিনি। এটা জাতীয় পার্টির পুনর্গঠন।

“বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক মানুষ বহিষ্কার হয়, বঞ্চিত হয়। তাদের নিয়ে আমি দলকে পুনর্গঠন করতে যাই। এরা জাতীয় পার্টির দুঃসময়ের মানুষ। এরশাদ সাহেবের কর্মী। আমি তাদেরকে নিয়েই পথ চলতে চাই।”

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভাবছেন কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, ২০১৭ সালে ৫৮ দল নিয়ে একটি নির্বাচনী জোট করেছিলেন এরশাদ সাহেব। সেই জোট নিয়ে বর্তমান চেয়ারম্যান কিছুই করেননি। সেই জোটের অনেকগুলো দলের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। তারাও আমার পাশে আছে।”

ওই দলগুলোর মধ্যে ইসলামিক ফ্রন্ট শুধু নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত।

বিদিশা বলেন, “নির্বাচন তো অবশ্যই লক্ষ্য। কিন্তু সব কথা এখন বলাটা ঠিক নয়। আমাদের নিজস্ব কিছু চিন্তা-ভাবনা আছে। দল গুছিয়ে নেই, তারপর এসব বিষয় নিয়ে কথা বলব।”

জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যে কারা কারা এই প্রক্রিয়ায় রয়েছেন, সে বিষয়ে কিছু বলতে চাননি তিনি।

রংপুরে ছেলেকে নিয়ে বিদিশা। ফাইল ছবি

বিভিন্ন জেলার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিশেষ করে রংপুরে যোগাযোগ বাড়ানোর বিষয়ে প্রশ্ন করলে বিদিশা বলেন, “শুধু একটা জেলা কেন। আমি সব জেলায় খোঁজ-খবর রাখছি। যোগাযোগ রাখছি। উত্তরবঙ্গের প্রতিটি জেলার সঙ্গে যোগাযোগ করছি। প্রেসিডেন্ট পার্কে অনেকেই আসছেন।”

চেয়ারপাসনের পদ নিতে রওশনের আগ্রহী নন বলে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে যে বক্তব্য এলেও বিদিশা মনে করেন, এরশাদের প্রথম স্ত্রীর ‘দোয়া’ তার উপর রয়েছে।

“দেখুন রওশন এরশাদ সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী। তিনি তো তার প্যাডে কোনো বিবৃতি দেননি। ওটা জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান দিয়েছে। ম্যাডামের (রওশন) দোয়া আমাদের সঙ্গে আছে।”

রওশন এরশাদ।

চেয়ারপারসন পদে জি এম কাদেরের থাকার  বৈধতা নেই বলে দাবি করেন বিদিশা।

“বর্তমান চেয়ারম্যানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট হয়েছিলো কোর্টে। সেটার জবাব এখনও দেননি তিনি। তার বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন আছে।”

‘মাথাব্যথা’ নেই কাদেরের

বিদিশার নতুন তৎপরতার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেখুন বিষয়টা নিয়ে কথা বলার মতো কিছু নেই।

“আমি আগেও বলেছি, দেশের সংবিধান অনুযায়ী যে কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারেন। রাজনৈতিক দল কেউ করলেই হবে না। নির্বাচন কমিশন থেকে সেই দলের নিবন্ধন নিতে হবে। আর এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান একই। এ ব্যাপারে আমাদের মাথাব্যথা নেই।”

ভাইয়ের সঙ্গে জি এম কাদের।

রওশন এরশাদ বর্তমানে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন থাকায় তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এরশাদের বড় ছেলে সাদ এরশাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি।

এরিকের ঘোষিত কমিটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মামুনুর রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও সাড়া দেননি।

নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিদিশা যোগাযোগ করছেন কি না- জানতে চাইলে এরশাদের জেলা রংপুরের জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জাতীয় পার্টি তো একটাই। এরশাদ সাহেবের জাতীয় পার্টি। সেই দলই আমরা করি। এর বাইরে আমরা কিছু চিনি না। কেউ যদি দলীয় শৃঙ্খলার বাইরে গিয়ে কাজ করে তবে সংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

দ্বন্দ্ব বাঁধছে, বদলাচ্ছে সমীকরণ

সামরিক শাসক এরশাদ জাতীয় পার্টি চালাতেন তার ইচ্ছামাফিক। তিনি দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ মহাসচিব বদলাতেন যখন-তখন। সেজন্য দেখা যায়, তিন দশকে ডজনখানেক মহাসচিব পেয়েছে জাতীয় পার্টি। আবার এই মহাসচিবদের তিনজন নতুন জাতীয় পার্টিও গঠন করেন।

বিয়ের পর তেমনি জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীতে স্থান পান বিদিশা; আবার নিজের প্রথম স্ত্রী রওশনকে আগে থেকে সেই পরিষদে বসিয়ে রেখেছিলেন এরশাদ।

এরশাদের জীবদ্দশায় রওশন-কাদের দ্বন্দ্বে বিদিশাকে জি এম কাদেরের পক্ষেই দেখা যেত। কিন্তু এরশাদের মৃত্যুর পর উল্টোচিত্র দেখা যায়।

২০১৯ সালের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুর পর ছোট ভাই জি এম কাদের দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের আগেই বসে যান চেয়ারম্যানের আসনে।

এরপর জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতার পদ নিতে দ্বন্দ্বে জড়ান ভাবি রওশনের সঙ্গে। তখন রওশনের নেতৃত্বে আলাদা কমিটির ঘোষণাও এসেছিল।

পরে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা বৈঠকের পর চেয়ারম্যানের পদে থাকলেও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদটি রওশনকে ছেড়ে দিতে হয় কাদেরকে। এরপর ওই বছরের ২৮ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির নবম কাউন্সিলে কাদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

এরশাদের বাড়ি প্রেসিডেন্ট পার্ক।

জি এম কাদেরের আপত্তি উপেক্ষা করে ছেলে এরিক এরশাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট পার্কে উঠে আসা বিদিশা দাবি করেন, তাকে ‘ভয়’ পাচ্ছেন এরশাদের ভাই।

গত বছর বিদিশা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “এখন যে চেয়ারম্যান এসেছে, তিনি নিজেই তো একজন বিতর্কিত চেয়ারম্যান। উনি এখন ক’দিন চেয়ারম্যান আছেন, সেটাই দেখার বিষয় অবশ্য। এটা আমরা দেখার অপেক্ষায় আছি।”

রওশনকে গুলশানের একটি বাড়ি দিয়ে ছোট ছেলে এরিককে নিয়ে এরশাদ প্রেসিডেন্ট পার্কে থাকতেন। এরিককে তিনি বিশাল সম্পত্তি দিয়ে গেলেও তার জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করে দিয়ে যান।

সেই ট্রাস্টি বোর্ডে রওশন, বিদিশা কিংবা জিএম কাদের কাউকে রাখেননি এরশাদ। বড় ছেলে সাদকেও রাখেননি। স্বজনদের মধ্যে শুধু এরিককে রেখে গেছেন সেই বোর্ডে।