১৫ অগাস্ট ছিল বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাসে চরম আঘাত: শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে অগাধ বিশ্বাস ছিল, তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই বিশ্বাসে ‘চরম আঘাত’ করা হয়েছিল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 August 2021, 11:38 AM
Updated : 1 August 2021, 11:40 AM

শোকের মাস উপলক্ষে রোববার কৃষক লীগ আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্ত ও প্লাজমা দান কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে এ কথা বলেন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে। 

স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় তখনকার রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় বেঁচে যান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যখন আমরা এই খবরটা পাই, আমরা কখনো এটা ভাবতেই পারিনি। কিন্তু একটা আশঙ্কা সব সময়ই ছিল। আর আমার বাবার অগাধ বিশ্বাস ছিল বাংলাদেশের মানুষের ওপর। তিনি সব সময় বিশ্বাস করতেন যে এই বাঙালি কখনো তার গায়ে হাত দিতে পারে না। পাকিস্তানিরা যখন চেষ্টা করে তাকে হত্যা করতে পারেনি, বাঙালিরা কেন মারবে?

“অনেকেই অনেকভাবে তাকে খবর দিয়েছেন,বলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তিনি কখনো বিশ্বাস করেননি। যখনই যারা বা কোনো রাষ্ট্রপ্রধান যখন তাকে বলেছেন,তখন তিনি একটা কথাই বলেছেন যে এরা আমার সন্তানের মত। ওরা কেন আমাকে মারবে? আর সেই বিশ্বাসে চরম আঘাত দিল যারা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করল।”

জাতির পিতার খুনিদের রক্ষায় সে সময় ‘ইনডেমনটি’ অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন তখনকার ‘স্বঘোষিত’ রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নিয়ে সংবিধান সংশোধন করে খুনিদের রক্ষার পথটি স্থায়ী করার প্রয়াস চালান। হত্যাকারীদের নানা পদ দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়।

সেসব কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বলেন, “জিয়াউর রহমান তাদেরকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেয়, ব্যবসা করার সুযোগ দেয়, বিপুল অর্থের মালিক করে দেয়। জিয়ার পথ ধরে আমরা দেখেছি জেনারেল এরশাদ এই খুনিদেরকে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়, রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হবার সুযোগ দেয়, এমনকি ভোট চুরি করে পার্লামেন্টেরও মেম্বার করে।

“তার থেকেও আরেক ধাপ উপয়ে গিয়ে খালেদা জিয়া এই খুনি রশিদকে পার্লামেন্টে ভোট চুরি, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে, ভোট চুরি করে তাকে নিয়ে এসে পার্লামেন্টে বসায় বিরোধী দলের নেতার চেয়ারে। এবং আরেক খুনিকে পার্লামেন্টের মেম্বার করে এবং তাদেরকে পুরষ্কৃত করে।”

১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ইতিহাসে চিহ্নিত কালো ওই অধ্যাদেশ বাতিলের পর জাতির পিতার খুনের বিচারের পথ খোলে।

ছবি: পিএমও

সে কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যেদিন প্রথম বিচারের রায়টা হবে ৮ নভেম্বর (১৯৯৮ সাল), খালেদা জিয়া বিরোধী দলে তখন, হরতাল ডেকেছিল, যেন কোনোমতে জজ সাহেব কোর্টে যেতে না পারেন আর বিচারের রায় দিতে না পারেন। কিন্তু সেই বিচারের রায় হয়েছিল।”

শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার হত্যাকারীদের মধ্যে যাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছিল, তাদের পাশপাশি দুজন খুনিকে থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।

“কিন্তু পরবর্তীতে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে শুধু বিচারের কাজই বন্ধ করেনি, অনেক আসামিকে আবারও দূতাবাসে চাকরি দেয়,পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি দেয়। এমনকি যখন রায় ঘোষণা হবে, তারিখ সুনির্দিষ্ট করা, তারপরও একজন খুনিকে খালেদা জিয়া চাকরি ফিরিয়ে দেয় এবং প্রমোশন দেয়।

“এই প্রমোশনটা দিয়ে তিনি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে এদের বিচার করা যাবে না। … একজন খুনি মৃত্যুবরণ করেছিল, সেই মৃত ব্যক্তিকে খালেদা জিয়া প্রমোশন দেয় এবং তাকে অবসরভাতা দিয়ে… যেহেতু তাকে আমরা ডিসমিস করেছিলাম… কাজেই তাকে অবসরভাতা দিয়ে পুরষ্কৃত করে। ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে এই খুনীদের আবারও পৃষ্ঠপোষকতা করে।”

অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলায় হাই কোর্টের রায় বহাল রাখলে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। দীর্ঘদিন পলাতক আরও এক খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২০২০ সালে। তবে মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে পাঁচজন এখনও পলাতক।

শেখ হাসিনা বলেন, “স্বাধীনতার পর জাতির পিতা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছিলেন, অনেকে সাজাপ্রাপ্তও ছিল, অনেকে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনে আর নাগরিকত্ব ফেরত দেয়।

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ৭ জন কর্মীকে প্রকাশ্য দিবালোকে যে হত্যা করেছিল, যে জেলে ছিল, জিয়াউর রহমান তাকেও মুক্ত করে রাজনীতি করা সুযোগ দিয়েছিল।”

ছবি: পিএমও

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এমনিভাবে সারা বাংলাদেশে যারা স্বাধীনতাবিরোধী, খুনী, যুদ্ধাপরাধী, একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারী, তাদেরকেই পৃষ্ঠাপোষকতা দেয়। ১৫ অগাস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর আমরা দেখেছি স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী যারা, তারাই কিন্তু মূলত ক্ষমতাটা দখল করে।”

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যারা অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিল, তারা বাংলাদেশকে ‘ভিক্ষুকের জাতিতে’ পরিণত করেছিল বলেও মন্তব্য করেন সরকারপ্রধান।

তিনি বলেন, “বাঙালি মাথা উঁচু করে বিশ্বে দাঁড়াক ,বাংলাদেশ টিকে থাকুক, বাংলাদেশের অস্তিত্ব থাকুক এটাই তারা চায়নি। এটাই হল বাস্তবতা।”

বর্তমানে করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ধন্যবাদ জানান দলের সভাপতি শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, “আমি মনে করি, জাতির পিতা আমাদের যে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, যে আর্দশ শিক্ষা দিয়ে গেছেন। তিনি তো এটাই চেয়েছিলেন, তার দল মানুষের পাশে থাকবে, দুর্যোগে মানুষের সাথে থাকবে। মানুষের কল্যাণে কাজ করবে।

“যদিও এটা করতে গিয়ে আমরা আমাদের বহু মানুষকে হারিয়েছি। অনেকেই করোনার জন্য মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের আত্মার আমি মাগফেরাত কামনা করি, আত্মার শান্তি কামনা করি।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ রক্ত তিনি নিজে কিন্তু দিয়ে গেছেন। কারণ, যখন এদেশের মানুষকে মুক্ত করেছেন, তখনই যারা আমাদের স্বাধীনতারবিরোধী ছিল বা আমাদের বিজয় চায়নি, তারাই কিন্তু তাকে হত্যা করে গেছে। তার রক্তের ঋণ আমাদের শোধ করতে হবে।”

কৃষকলীগের রক্তদান কর্মসূচিদে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা অন্তত এই রক্তদানের মাধ্যমে একটি মুমূর্ষু রোগী যদি বাঁচাতে পারি, সেটাই তো সব থেকে বড় কথা, যে মানবকল্যাণে আপনি রক্ত দান করছেন। আর এতে নিজের কোনো ক্ষতি হয় না, বরং উপকার হয়। এই কর্মসূচি সফল হোক আমি সেই কামনা করি।”

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর সংলগ্ন এলাকায় এ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, বাংলাদেশ কৃষক লীগের সভাপতি সমীর চন্দ, সাধারণ সম্পাদক উম্মে কুলসুম স্মৃতিসহ সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।