জিয়া, খালেদা, এরশাদ ‘একই বৃন্তের ফুল’: শেখ হাসিনা

দেশের গণতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে সাবেক দুই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদ এবং জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়ার শাসনামলের কথা মনে করিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 July 2021, 04:36 PM
Updated : 4 July 2021, 12:44 PM

তিনি বলেছেন, “জিয়া, খালেদা জিয়া, এরশাদ- সব একই বৃন্তের কয়েকটি ফুল। তারা একই কাজ করেছে।”

শনিবার সংসদের বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বিএনপি ও জাতীয় পার্টির উৎপত্তি এবং তাদের শাসনামলে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন। 

বিএনপি ও জাতীয় পার্টি গঠনের ইতিহাস তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সংসদে বলেন, “যাদের জন্মই হয়েছে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী সেনা শাসকের পকেট থেকে, তারা গণতন্ত্রের কী বোঝে! তারা গণতন্ত্রের কী শেখাবে আমাদেরকে?”  

শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ ‘মাটি ও মানুষ থেকে গড়ে ওঠা দল’। দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর গড়ে তোলা এ দলের অগ্রণী ভূমিকা ছিল।

“ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে জনগণের বাঁচার অধিকার এবং এই দেশকে স্বাধীন করার পুরো পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ গঠিত। আওয়ামী লীগ ধ্বংস করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু পারেনি। পারবেও না, কারণ আওয়ামী লীগের শেকড় অনেক শক্তিশালী।”

স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় বেঁচে যান।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতার পটপরিবর্তনে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়া। তার হাতে গঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি।

জিয়া এক সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পর তখনকার সেনাপ্রধান এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করতে তিনি গড়ে তোলেন জাতীয় পার্টি।

স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের পথ ধরে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর পতন ঘটে এরশাদের। এরপর ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬, এই দুই মেয়াদে দেশ শাসন করেন জিয়ার স্ত্রী বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া।

রাজনৈতিক সঙ্কটে দুই বছরের জরুরি অবস্থা শেষে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। এরপর টানা তিন মেয়াদে বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগই দেশ শাসন করছে। 

সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: পিএমও

প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেন, আওয়ামী লীগ ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকারে আসে’ বলেই ক্ষমতায় ‘টিকে থাকতে পারে’। আর আওয়ামী লীগ টিকে থাকার কারণেই দেশের ‘উন্নতি হয়’।

“কারণ যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে, তারা ক্ষমতা হারাই হারাই ভয়ে মরে, শুধু টাকা বানাতে থাকে, পয়সা বানাতে থাকে, বিলাস ব্যাসনে চলা, শো-সা দেখানো, হাই ফাই চলা- এইসব করে বেড়ায়। বাংলাদেশের মানুষের দিকে কেউ চেয়ে দেখে না।”

তিনি বলেন, “আজকে আওয়ামী লীগ সরকারে থেকে মানুষের জন্য কাজ করছে বলেই মানুষ পেট ভরে খেতে পারছে, মানুষের ঘর হচ্ছে, চিকিৎসা পাচ্ছে, মানুষ বাঁচার জন্য অন্তত একটা উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারছে।”

এরশাদ সরকারের সময়ের বিচার ব্যবস্থার সমালোচনা করে সরকারপ্রধান বলেন, “এখানে বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে বিরোধী দলীয় উপনেতা কথা বলেছেন। আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বাংলাদেশে বিচারপতি নিয়োগের যে নমুনা ছিল, সেই নমুনা যদি আপনারা স্মরণ করেন… বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন। তিনি এজলাসে বসে আছেন, প্রধান বিচারপতি। কিন্তু তিনি জানেন না যে তিনি নাই।

“তখন মাননীয় উপনেতা ( বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদের), আপনার বড় ভাই জেনারেল এরশাদ সাহেব ক্ষমতায়। তিনি রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির এক কলমের খোঁচায় বিচারপতি নাই।”

বিএনপির শাসনামলে অবস্থা ‘আরো ভয়াবহ ছিল’ মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “একেবারে ভুয়া সনদ নিয়ে বিচারপতি নিয়োগ, জাল সার্টিফিকেট। হাতে নাতে ধরা। শুধু তাই না… একজন বিচারপতি, তিনি এক মামলার রায় দেবেন, ছাত্রদলের সেক্রেটারির গলায় হাত দিয়ে বসে সেই রায় নিয়ে আলোচনা করছেন। সেটাও দেখা গেল।

“তাছাড়া ভোট চুরির সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রধান বিচারপতি কে হবেন, তার বয়স বাড়িয়ে দিয়ে সে যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হতে পারে, সেই ব্যবস্থা সৃষ্টির নজিরও বিএনপি তৈরি করেছিল।”

বিএনপি সরকারের আমলে দেশের ৬৪ জেলার আদালতে জঙ্গিদের বোমা হামলা এবং ঝালকাঠি ও গাজীপুরে দুইজন জেলা জজ নিহত হওয়ার ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা তার সরকারের সময় বিচার বিভাগের উন্নয়নে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা সংসদে তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “একই দিনে একই সময়ে শুধু এই কান্ড না, সারা বাংলাদেশে ৬৩ জেলায় একই সময় বোমা ফুটল। কারণটা কি? এত শান্তিপূর্ণ অবস্থায় তারা রেখেছিল বিএনপির আমলে, এখন তাদের কাছ থেকে শুনতে হয় যে বিচার ব্যবস্থা, বিচারক নিয়োগ ইত্যাদি।”  

প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা নিয়ে বিএনপি এখন উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কিন্তু বিএনপি আর জাতীয় পার্টির আমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কী ছিল?

“প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন-খারাবি লেগেই ছিল। বোমাবাজি, গুলি, মানুষ খুন, ক্লাস বন্ধ, সেশন জট। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর এগুলো বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।”

তিনি বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনার মূল শক্তি ছিল জিয়াউর রহমান, যা খুনি কর্নেল রশীদ এবং খুনি ফারুক বিবিসিতে দেওয়া স্বাক্ষাতকারে বলে গেছে। খন্দকার মোশতাকের সব থেকে প্রিয় ছিল জিয়াউর রহমান। যদি জিয়াউর রহমান তাদের সাথে না থাকত, তাহলে কোনোদিন এই ষড়যন্ত্র করতে পারত না।”

শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমানের ‘সংসার টিকিয়ে রাখতে’ বঙ্গবন্ধু তাকে উপ সেনা প্রধান করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান ‘একদিকে সেনাপ্রধান, অন্যদিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি’ বনে যান।

“এই দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিল আইযুব খান। ইস্কান্দর মির্জা শখ করে আইয়ুব খানকে প্রধান সেনাপতি বানিয়েছিল। আইয়ুব খান তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেয়। জিয়াউর রহমান সেই খুনি আইয়ুবের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দেয়।

“এরপর ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের খুন করে, জেলে দেয়। আজকে গুম, খুনের কথা বলেন? বিমান বাহিনীর ৬৬৫ জন অফিসার কর্মচারী হত্যা হয়েছে জিয়ার হাতে।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার, যারা জীবন দিয়ে যুদ্ধ করেছে, একে একে তাদেরকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার সৈনিককে হত্যা করেছে। পরিবার পরিজন লাশও পায়নি। তারা জানে না, তাদের অপরাধ কী।

“রাতের পর রাত এই হত্যাযজ্ঞ চলেছে। একেক দিন দশটা করে ফাঁসি, জিয়াউর রহমান সই করে যাচ্ছেন। উর্দি পড়ে ক্ষমতায় এসে আবার রাজনীতিতে নামলেন। সেখানে এসে দল গঠন। আর সেই দলই হল বিএনপি।”

বিএনপিকে ‘পাকিস্তানপন্থি রাজনৈতিক দল’ আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বি এন পি, বাংলাদেশ নাহ, পাকিস্তান হ্যাঁ। এই তো বিএনপি? এই হল তাদের রাজনীতি, এই হল তাদের গণতন্ত্র।”

শেখ হাসিনা বলেন, “জিয়াউর রহমান দিয়েছিলেন কারফিউ গণতন্ত্র। অনেকগুলো দল করার সুযোগ দিয়েছিল, এটা ঠিক। কিন্তু সেখানে গণতান্ত্রিক চর্চা ছিল না। আর সেই নির্বাচনের যে রেজাল্ট, তা আগেই নির্দিষ্ট। ৭৮ সালের হ্যাঁ-না ভোট, ৭৯ সালের নির্বাচন- সবই ছিল খেলা।

“আর তার পরবর্তীকালে যদি আসেন, এরশাদ সাহেবও ৮৬ সালের নির্বাচনে আটচল্লিশ ঘণ্টা ভোটের ফলাফল আটকে রেখে আওয়ামী লীগকে হারাল।”