অন্য সব ঘটনা আড়াল করতেই পরীমনিকে সামনে আনা: ফখরুল

বিভিন্ন ঘটনা থেকে মানুষের দৃষ্টি ফেরাতে চিত্রনায়িকা পরীমনিকে সরকার সামনে আনছে বলে মনে করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 June 2021, 01:46 PM
Updated : 16 June 2021, 01:46 PM

বুধবার এক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি বলেন, “এই যে দেখেন সাংবাদিক ভাইয়েরা- খুব লাফালাফি হচ্ছে এখন। ইস্যুটা হচ্ছে পরীমনি। হু ইজ পরীমনি?

“আমরা কি বুঝি না যে, আপনার (সরকার) আবার সেই ডাইভারশন, আবার সেই অন্যদিকে নিয়ে যাওয়া। প্রতি মুহুর্তে জনগণকে বিভ্রান্ত করা, প্রতারণা করা, মিথ্যাচার করা- এটাই কিন্তু ওদের (ক্ষমতাসীন) মূল কাজ।”

কী থেকে জনগণের দৃষ্টি ফেরানো হচ্ছে- সে বিষয়ে ফখরুল বলেন, “যখন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য, তার মুক্তি নিয়ে কথা ‍উঠছে, যখন দেশের গণতন্ত্র নিয়ে কথা উঠছে, যখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একেবারে চরম ব্যর্থতা, কোভিড যখন চরমে উঠছে, তখন আবার একটা এদের নিয়ে ডাইভারশন করা হচ্ছে।

“মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা, এই যে খেলা- এটা আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্ভব। একরম কৌশল করেই তারা সমস্ত জাতিকে দমন করে রাখছে। তারা প্রতারক সরকার, জনগণের সাথে প্রতারণা করেই এভাবে ক্ষমতায় বসে আছে।”

চিত্রনায়িকা পরীমনি সম্প্রতি এক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ-হত্যাচেষ্টার অভিযোগ করেন। এই নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে ঢাকা বোট ক্লাবের দুই সদস্যকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। এদের একজন জাতীয় পার্টির নেতা। তাদের মাদকের এক মামলায় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

এই প্রসঙ্গে ফখরুল বলেন, “আমি জানি না কী সত্য, কী ঘটনা। কিন্তু কালকে এই ঘটনাটা দেখে মনে হয়েছে যে, এভরি থিং ইজ পসিবল ইন দিস কান্ট্রি। মামলা করলো একটা, আর আরেক ঘটনার দায়ে নিল রিমান্ডে।

“আপনারা মামলা করলেন ধর্ষণ এবং হত্যার চেষ্টার। রিমান্ডে নিচ্ছেন এই জন্য যে তার কাছে মাদক পাওয়া গেছে। যেখান থেকে তাকে অ্যারেস্ট করেছে, সেই বাড়িটিও তার নয়, এটা আরেক জনের বাসা।”

তিনি বলেন, “আজকে অনেক প্রশ্ন এসেছে তাহলে কী শুধু ক্ষমতাসীনরা, ক্ষমতাধারীরা যা চাইবেন তাই হবে। এই প্রশাসন যাকে ইচ্ছা, যাকে খুশি তাকেই তুলে নিয়ে যাবে। তার সম্মান, ইজ্জত, তার পরিবারের কাছে ইজ্জত, সমাজের কাছে ইজ্জত সমস্ত কিছু ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।”

‘বিরোধী দল সরকার চায় না’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আওয়ামী লীগে সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন যে, বিএনপির সঙ্গে এক সঙ্গে বাস করা যায় না।

“তার এই বক্তব্যে তাদের আসল যে চরিত্র, তাদের আসল যে মানসিকতা, সেটা বেরিয়ে এসেছে। তারা শক্তিশালী বিরোধী দল তো দূরের কথা, কোনো বিরোধী দলই চায় না। তার এই বক্তব্য থেকে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে।”

সারাদেশে সাংবাদিকদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতনের জন্য সরকার ও প্রশাসনকে দায়ীকরে ফখরুল বলেন, “দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদ সাহেবকে দীর্ঘদিন আটক করে রাখা হয়েছিল, সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজী সাহেবকে প্রায় ৮ মাস যাবত আটক করে রাখা হয়েছে, শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমানের মতো সম্পাদক দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

“প্রায় ৬০ জনের বেশি সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন শুধু জীবনের ভয়ে।

আর যারা দেশে আছেন, তারা লিখতে পারেন না। লিখতে না পারার জন্য কখনও আমি তাদের দোষারোপ করি না। কারণ যে ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে, যে সেলফ সেন্সরপিপ নিজেদেরকে আরোপ করে নিতে হয়েছে, তা হচ্ছে একমাত্র জীবনের ভয়ে, জীবিকার ভয়ে, সন্তান হারানোর ভয়ে, মামলার ভয়ে। ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, কিভাবে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ের ভেতরে নির্যাতন করা হল।”

এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে বিএনপি গঠিত জাতীয় কমিটির উদ্যোগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘১৬ জুন সংবাদপত্রের কালো দিবস’ উপলক্ষে এই গোল টেবিল আলোচনা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৬ জুন বাংলাদেশে চারটি পত্রিকা রেখে সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। দিনটিকে বিএনপি ‘সংবাদপত্রের কালো দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, “দেশে একটা বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া চলছে, দেশকে একটা নেতৃত্বশূন্য করার প্রক্রিয়া চলছে- এখান থেকে কোনো একটা প্রতিষ্ঠা কিংবা জাতির কোনো একটা অংশ বাদ যাচ্ছে না।”

স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, “সংবাদপত্রের স্বাধীনতার চেয়ে সাংবাদিকের স্বাধীনতা আজ বেশি প্রয়োজন। কারণ মালিকের স্বাধীনতা আছে। মালিক আর সরকার জয়েন্ট ভেঞ্চারে চলে। কখনও মালিক সরকারকে ব্ল্যাকমেইল করে, কখনও সরকার মালিকদের ব্ল্যাকমেইল করে।”

স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, “আজকে ১৬ জুন সংবাদপত্রের কালো দিবস, আবার আজকের দিনটা হল আন্তর্জাতিক গৃহ শ্রমিক দিবস। সবার কাছে আমার বিনীত নিবেদন থাকবে যে, সংবাদপত্রের দলনের যে দিনটা সেদিন সংবাদপত্রের যারা কর্মী ছিল, তাদেরকে সরকারের অধীনস্থ করে গৃহশ্রমিক বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই দিনটাকে একটা কলংকের দিন হিসেবেই আমরা যেন বিবেচনা করি।”

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ বলেন, “মিডিয়ার স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতার জন্য যে আন্দোলন হবে এই আন্দোলন গণতন্ত্রের আন্দোলনের থেকে পৃথক কোনো আন্দোলন নয়। একই সমন্বিত আন্দোলন করতে হবে।”

ভবিষ্যতে বিএনপি সরকার গঠন করলে একটা প্রেস কমিশন গঠন করার দাবি জানান তিনি।

ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের(বিএফইউজে) একাংশের সভাপতি এম আবদুল্লাহ বলেন, “আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতাসীন হয়েছে, তখন প্রথমেই গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন পড়েছে। সেটা কী ৭৫, কী ৯৬, কী ২০০৯, তাদের প্রত্যেকটি শাসনে তাদের প্রথম টার্গেটে পরিণত হয়েছে গণমাধ্যম।

“আমাদের কাছে পরিসংখ্যান আছে যে, গত ১২ বছরে ৪২ সাংবাদিক হত্যা হয়েছে। সর্বশেষ সাংবাদিক মোজাক্কির যেটা আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন বসুরহাটে। গত বছর ২০২০ সালে ১৬৯ জন সাংবাদিক নিগৃহীত হয়েছেন। আর ১২ বছরে নিগৃহীতের সংখ্যা দেড় হাজার সাংবাদিক। আমাদের কাছে পরিসংখ্যান আছে, সেই পরিসংখ্যান বলছে যে, ৯০ ভাগ সাংবাদিকই নিগৃহীত হয়েছেন সরকারি দল ও প্রশাসনের হাতে।”

ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি কাদের গনি চৌধুরী বলেন, “মিডিয়ার যদি স্বাধীনতা চান, গণতন্ত্র যদি চান, তাহলে এই ফ্যাসিবাদী সরকারকে ‘না’ বলতে হবে। আমি সবাইকে আহবান জানাব, যার যার অবস্থান থেকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।”

আবদুস সালামের সভাপতিত্বে ও শামা ওবায়েদের সঞ্চালনায় গোল টেবিল আলোচনায় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুল হাই শিকদার, দৈনিক দিনকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রেজোয়ান সিদ্দিকী, বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব এমএ আজিজ ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খান বক্তব্য রাখেন।