অর্থপাচার নিয়ে সংসদে ক্ষোভ সরকারদলীয় এমপির

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণার পরেও ‘অর্থ পাচার হওয়ায়’ সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সরকারি দলের সংসদ সদস্য আলী আশরাফ।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 June 2021, 09:33 AM
Updated : 6 June 2021, 11:18 AM

রোববার সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে কুমিল্লা-৭ আসনের সংসদ সদস্য আলী আশরাফ অর্থ পাচার নিয়ে কথা বলেন।

সাবেক এই ডেপুটি স্পিকার বলেন, “বাজেট তো দিচ্ছি আমরা। কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য সদিচ্ছা থাকতে হবে। দুর্নীতি ও অর্থ পাচার… কিছু কিছু লোক… এখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যাদের সামনে রেখে বলতে পারি। জীবনের মায়া নিয়ে আমরা যুদ্ধ করি নাই। কিছু পাবার, খাবার বা প্রত্যাশার জন্য যুদ্ধ করিনি।

“লড়াই করেছিলাম বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। সেই দেশে আজকে ঘৃণা, লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। এত বড় বড় কিছু চোর, যাদের নাম ওঠে। অথচ প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকার দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স’। অথচ অর্থপাচারকারী… আমার মনে হয় এসবরে বিরুদ্ধে যথেষ্ঠ শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।”

বাজেট সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে কর প্রশসানের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন আওয়ামী লীগের এই জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য।

তিনি বলেন, “কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। আমাদের মুহিত সাহেব যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, ২০১০ সালে তিনি বলেছিলেন উপজেলা পর্যায়ে কর প্রশাসন…। ২৫ লাখ লোক কর দেয়। এটা গৌরবের কথা। ট্যাক্সের নেট আরও বাড়াতে হবে। দক্ষতা বাড়াতে হবে।

“কর প্রশাসনের সামর্থ্য আছে। কর প্রশাসনের দক্ষতা, স্বচ্ছতা, সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা যদি আমরা না বাড়াতে পারি তাহলে বাজেটে ইপ্সিত লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারব না।”

মহামারী মোকাবেলায় সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপের প্রশংসা করে তিনি বলেন, “কোভিডের তৃতীয় ঢেউ যদি আসে, আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের সামনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আছেন। 

“কোভিড-১৯ এর প্রথম ধাপ, দ্বিতীয় ধাপ এখন তৃতীয় ধাপ উঁকি দিচ্ছে। এর মধ্যে এই জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করা হয়েছে। এটা ভালো বাজেট। সম্ভাবনার বাজেট। এই বাজেট, সম্পূরক নিয়ে আলোচনা চলছে। সারা জাতি জানে কীভাবে এই সম্পূরক বাজেট, প্রায় ১৯টি মন্ত্রণালয়ের অর্থ কাটছাঁট করতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী প্রণোদনা দিয়ে অর্থনীতিকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছেন।”

আলী আশরাফ বলেন, মহামারীর মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বে ‘তাক লাগিয়ে’ দিয়েছে।

“কোভিড পরিস্থিতিতে যে বিপর্য়য়ের কথা ছিল, তার (প্রধানমন্ত্রী) নেতৃত্বে আমরা মোকাবিলা করেছি। এটা চাট্টিখানি কথা নয়। এটা নিশ্চয়ই সফলতা। সারা পৃথিবী বাংলাদেশে গৃহীত পদক্ষেপের প্রশংসা করছে। তৃণমূলে প্রণোদনা পৌঁছেছে। মানুষ আজ উদ্বেলিত। সততা থাকলে এটা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সেই সততা আছে।“

সরকারি দলের আরেক সদস্য সাবেক মন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, “কোভিডের কারণে আয় কমেছে। যে কারণে মূল বাজেটের চেয়ে সম্পূরক বাজেট কমে গেছে।”

মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে তিনি মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা খাত আরও সম্প্রসারিত করা, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন।

সাবেক এই আমলা বলেন, সরকার স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। দেশে ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থা বেশ প্রসারিত হয়েছে। এই ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।

এজন্য একটি ব্যাংক কমিশন গঠনের পাশাপাশি কর কমিশন করাও পরামর্শ দেন তিনি।

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বাজেটের সমালোচনাকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, “এই অর্থবছরে সিপিডি-বিএনপির নেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়ার কারণ অন্য। মেগা প্রজেক্টগুলো শেষ হয়ে এসেছে। তা দেখে তারা আবোল-তাবোল বকছে।”

বাংলাদেশ রাজনীতির শিকার: হারুন

করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে বাংলাদেশ ‘আন্তর্জাতিক রাজনীতির শিকার’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ।

সম্পূরক বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, “চীন ও রাশিয়া ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে প্রথমে এসেছিল। তারা ট্রায়াল দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা তাদের ট্রায়ালের অনুমতি দিইনি। তাদের প্রস্তাব সেই সময় গ্রহণ করলে এখন আমাদের ভ্যাকসিনের সঙ্কট হত না।

“ভ্যাকসিন নিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক রাজনীতির শিকার। যে কারণে ভ্যাকসিন নিয়ে চীনের সাথে কথা হলেও ভ্যাকসিন পাব কি না তা অনিশ্চিত। আশা করব, এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণে সরকার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে।“

বাজেটে ভ্যাকসিনের সুনির্দিষ্ট কোনো পথরেখা ‘দেওয়া হয়নি’ মন্তব্য করে বিএনপির এই এমপি বলেন, “ভ্যাকসিন আমাদের দিতে হবে। দেড় বছর হল আমরা করোনা প্রাদুর্ভাবে পড়েছি। দুই শতাংশ মানুষকেও আমরা এ সময়ে ভ্যাকসিন দিতে পারিনি।”

সরকার করোনাভাইরাসের ভারতে পাওয়া ধরন (ডেল্টা) ঠেকাতে ‘ব্যর্থ’ হয়েছে মন্তব্য করে হারুন বলেন, “গোটা বাংলাদেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সারা দেশকে অস্থির করে তুলেছে। রাজশাহী বিভাগে করোনা মারত্মক পরিস্থিতি ধারণ করছে। মওসুমে আম চাষীরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।“

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জন্য চলতি অর্থ বছরে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা জনগণের কাজে লেগেছে বা কোভিড নিয়ন্ত্রণে ব্যয় হয়েছে সরকার তা বলতে পারবে না। কত টাকা কোভিড নিয়ন্ত্রণে ব্যয় হয়েছে সরকারকে তার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে হবে।“

স্বাস্থ্য বিভাগের সংস্কারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “সরকারি চিকিৎসকরা সরকারি হাসপাতালে ডিউটি না করে ব্যক্তিগত ক্লিনিকে দায়িত্ব পালন করছেন।“

হারুন বলেন, “পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল আমরা চাই। কিন্তু তার আগে মানুষকে বাঁচাতে হবে। মানুষ বাঁচলে সবকিছু আসবে। স্বচ্ছ তালিকা করে সামাজিক সুরক্ষা খাতের অর্থ দিতে হবে।“

নতুন অর্থবছরের বাজেটের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “অর্থমন্ত্রীর বাজেটের শিরোনাম শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু বাইরে এর প্রতিক্রিয়া ভালো নয়। নতুন অর্থবছরের ছয় লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার বাজেটে বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণ নির্ভর। এই ঋণ নির্ভর বাজেট ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এত ব্যাপক ঋণ নির্ভর বাজেটে অতীতে কোনো সরকারের আমলে হয়নি।

“চলতি বছরের বাজেট অবাস্তবায়িত রয়েছে। করোনাকালীন সরকারের যে বাজেট দেওয়া দরকার ছিল, সরকার তা দিতে পারেনি। সরকারের নীতি ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে জনদুর্ভোগ ও মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে।“

তিনি বলেন, “ঈদের সময় মানুষের দুর্ভোগ আমরা দেখেছি। ৫০০ টাকার ভাড়া তিন/চার হাজার টাকা দিতে হয়েছে। ফেরিঘাট থেকে ঢালাওভাবে মানুষ পার হওয়ায় সংক্রমণ বেড়েছে। বেআইনি স্পিডবোটে পার হতে গিয়ে কতগুলো প্রাণ গেল। এর দায় সরকারকে নিতে হবে না?”

সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে হারুন বলে, “দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। অথচ দেখলাম নতুন বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এটা কোন কথা হল? আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানসম্মত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে সেখানে বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। কেন সেখানে করারোপ করা হল? এ বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এই কর প্রত্যাহার হওয়া উচিত।“

অন্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের আব্দুস শহীদ, তাহজীব আলম সিদ্দিকী, সেলিমা আহমাদ এবং বিএনপির রুমিন ফারহানা সম্পূরক বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নেন।