চুরানব্বইয়েও দেশে ‘নির্বাসিত’ ছিলেন বঙ্গবন্ধু: জাফর ইকবাল

আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফেরার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে, সেই পরিস্থিতিকে ‘অসহনীয়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন কথাসাহিত্যিক জাফর ইকবাল।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2021, 05:08 PM
Updated : 7 Feb 2021, 05:08 PM

রোববার গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’ এর অষ্টম পর্বের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “১৯৯৪ সালে আমি যখন দেশে ফিরি, তখন আবিষ্কার করলাম, এদেশ থেকে বঙ্গবন্ধু নির্বাসিত। চিন্তাও করতে পারবেন না, এটা কি অবস্থা।”

সেই সময়ের বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, “১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তখন বাসায় টেলিভিশন আনি এই ভেবে যে, এবার বঙ্গবন্ধুকে দেখাবে। এটা নিয়ে বেশি মানুষ কথা বলে না। আমি এটা সহ্যই করতে পারি না। কেমন করে এদেশের কিছু মানুষ, রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধুকে এদেশ থেকে নির্বাসিত করেছে, যে মানুষটা বাংলাদেশের সমার্থক!”

এখন আবার বঙ্গবন্ধুকে স্ব-মহিমায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান আটকে গিয়েছিল। এখন দেশে দ্রুত সংক্রমণ কমে আসছে। টিকা এসে গেছে। আমরা আবার সুন্দরভাবে এটি পালন করতে পারব।”

আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) উদ্যোগে রোববার সন্ধ্যায় এক ওয়েবিনারে গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’ এর নতুন পর্বের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। সোমবার থেকে সারাদেশে তা পাওয়া যাবে।

‘মুজিব’ এর এবারের পর্বে বাঙালির ভাষা আন্দোলন এবং তাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে।

নতুন প্রজন্মের সামনে বঙ্গবন্ধুকে তুলে ধরতে এই গ্রাফিক নভেল ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন জাফর ইকবাল।

“আমি খুব খুশি হয়েছি গ্রাফিক নভেলের জন্য। কারণ আজকাল ছেলেমেয়েরা বই পড়তে চায় না। ফেইসবুক নাকি কিসের কারণে জানি না, বই থেকে সরে যাচ্ছে। ওদের তো পড়তে হবে, জানতে হবে।

“ওরা যদি মুক্তিযুদ্ধের কথা না জানে, বঙ্গবন্ধুর কথা না জানে; তাহলে তো বাংলাদেশের নাগরিকই হতে পারবে না। এটা খুব ভালো আইডিয়া, গ্রাফিক নভেলের মাধ্যমে তার জীবনের কিছু অংশ দেখানো যাবে।”

কমিকস, কার্টুন, অ্যানিমেশনের প্রতি নিজের আকর্ষণের কথা জানিয়ে লেখক জাফর ইকবাল বলেন, “এই গ্রাফিক নভেলের মাধ্যমে অনেক কিছু জানা গেছে। যেগুলো মানুষের চোখে আগে পড়েনি।

“বঙ্গবন্ধু বইগুলো লিখেছেন, প্রকাশিত হয়েছে; সেটা বড় একটা কাজ হয়েছে। কারণ আমরা অনেক কিছু জানতে পেরেছি, অন্যথায় এগুলো জানা যেত না। সেটার গ্রাফিক নভেলে অন্যরকম আবেদন থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক।”

তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু অসম্ভব হ্যান্ডসাম মানুষ ছিলেন। দুষ্টু ছিলেন, সেটি নিজেই লিখেছেন তিনি। এগুলো যখন কমিকসে এসেছে, তখন ছোটরা পড়ে খুব মজা পাবে।

“আমরা জানি না বঙ্গবন্ধুকে কতটা দেখাতে পারব। কিন্তু এটা আমাদের দায়িত্ব, পরবর্তী প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুকে জানানো-বোঝানো। তাহলে তারা তাকে অনুভব করতে পারবে। আমরা পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি।”

ছোট্ট জীবনে যে বিপুল কর্মযজ্ঞ বঙ্গবন্ধু রচনা করেছেন, সে প্রসঙ্গে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে পুরোপুরি তুলে ধরা অসম্ভব। খামাখা এটার জন্য চেষ্টা করে লাভ নেই। যে যেটুকু পারি, সে ততটুকু তুলে ধরব।

“একজন মানুষ, যতই দিন যাচ্ছে, যতই তাকে দেখছি, ততই টের পাচ্ছি তার জীবনটা একটা অসম্ভব জীবন। একজন মানুষের জীবনে যে এতকিছু থাকতে পারে, সেটা তো নিজের চোখে দেখছি, পড়ছি। আমরা তার তিনটা বই পড়লাম। যে বিষয়টা আগে জানতাম না, এখন জানলাম, তিনি কত বড় লেখক।”

গ্রাফিক নভেলটির সব পর্ব নিয়ে একটি বই প্রকাশের পরামর্শ দেন অধ্যাপক জাফর ইকবাল। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর পুরো জীবন নিয়ে আলাদা আরেকটি গ্রাফিক নভেল করার তাগিদ দেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও বিস্তৃত পরিসরে কাজ করার পরামর্শ দিয়ে জাফর ইকবাল বলেন, “আরও গবেষণা করা খুব দরকার। যেটি আমাদের নেই, এগুলো আমাকে পীড়া দেয়।

“শুধু নিজেরা না, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশকদের নিয়ে কাজ করতে হবে। পৃথিবীতে আমাদের গল্পগুলো ছড়াতে হবে, এগুলো গৌরবের ব্যাপার। পৃথিবী দেখুক বঙ্গবন্ধুকে, তারা বিস্মিত হয়ে যাবে।”

তিনি বলেন, “দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ গবেষকদের কাজে লাগাতে হবে। ইংরেজিতে লিখতে হবে। অন্যান্য ভাষায়ও এগুলো অনুবাদ করতে হবে।”

শিবু কুমার শীলের সঞ্চালনায় ওয়েবিনারে আরও বক্তব্য রাখেন লেখক ও 'সার্ভাইভিং৭১'-এর পরিচালক ওয়াহিদ ইবনে রেজা, গ্রাফিক নভেল মুজিবের কার্টুনিস্ট সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময় এবং সংগীতশিল্পী কারিশমা সানু।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকাশের পর শিশু-কিশোর ও তরুণদের কাছে তার ঘটনাবহুল জীবন নতুন রূপে তুলে ধরতে বইটিকে গ্রাফিক নভেলে রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক।

বিভিন্ন দেশে বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে গ্রাফিক নভেল হলেও বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ এটাই প্রথম।

২০১৫ সালের ১৭ মার্চ গ্রাফিক নভেল মুজিবের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে সিআরআইয়ের উদ্যোগে এর বিভিন্ন পর্ব প্রকাশিত হয়ে আসছে।

অষ্টম পর্বের শুরুতে দেখা যাবে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য উত্থাপিত বিলটি পাকিস্তানের সংবিধান সভায় বাতিল করা হয়েছে।

ওই ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের হয়ে আন্দোলনে যোগ দেন। তমুদ্দিন মজলিশের সাথে মিলে গঠন করেন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ১১ মার্চ ভাষার দাবিতে পাকিস্তানে প্রথম হরতাল হয়। সেই হরতালের নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহনেতারা।

১৯৪৮ সালে এভাবেই সাধারণ জনগণের মাঝে বপিত হয় ভাষা আন্দোলনের বীজ। দেশ ভাগ, মহাত্মা গান্ধীর সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ, ভাষার জন্য আন্দোলন এবং তার কারাবরণের মত ঘটনাগুলো নিয়ে সাজানো হয়েছে গ্রাফিক নভেল 'মুজিব'-এর অষ্টম পর্ব।

অসমাপ্ত আত্নজীবনী থেকে মার্চের মধ্যেই এই গ্রাফিক নভেলের আরও দুটি পর্ব প্রকাশের আশা প্রকাশ করেছেন আয়োজকরা।

এর আগে প্রথম পর্বে খেলাধুলা, পড়াশোনা, ডাক্তারের কাছ থেকে পালানো, প্রথমবারের মতো কারাবরণের মত বিভিন্ন কৌতূহলোদ্দীপক কাজের পাশাপাশি দেশের প্রতি তরুণ বয়স থেকেই নিজের বিশ্বাসের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিতে দেখা যায় কিশোর শেখ মুজিবকে।

দ্বিতীয় পর্বে রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর হাতেখড়ির পাশাপাশি তার প্রেরণা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠার বিষয়টি জানা যায়।

তৃতীয় পর্বে বঙ্গবন্ধুর স্কুল ও কলেজ জীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষের সময় মানবিক ভূমিকার বিষয়গুলো উঠে আসে।

'মুজিব'-এর চতুর্থ পর্বে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ সম্মেলন শেষে তরুণ শেখ মুজিবের দিল্লির বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ ও ১৯৪৪ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে তার ভূমিকা চিত্রায়িত হয়েছে।

অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও ১৯৪৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে কীভাবে ছাত্রলীগের পদ থেকে বঞ্চিত করা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধকে কেন্দ্র করে কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কালোবাজারি এবং দেশের কিছু এমএলএ ও খান বাহাদুরদের স্বার্থের টানাপড়েনের কারণে ব্রিটিশ গভর্নরের কাছে ক্ষমতা চলে যাওয়ার ঘটনা বর্ণনা করা হয় পঞ্চম পর্বে।

খাজা নাজিমুদ্দিনের নানা কূটকৌশলের বিপরীতে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান নিয়ে প্রকাশিত হয় গ্রাফিক নভেল মুজিবের ষষ্ঠ পর্ব। মূলত, গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার অতি সাধারণ এক পরিবারে জন্ম নেওয়া এক কিশোর, কৈশোর, যৌবন পেরিয়ে ধীরে ধীরে কীভাবে এই বাংলার ভবিষ্যৎ দিক নির্ধারক হয়ে উঠলেন– সেই গল্প দৃশ্যমান হয় এ পর্বে। আর সপ্তম খণ্ডে উঠে আসে তৎকালীন দুর্ভিক্ষের চিত্র।

বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি ও জাপানি ভাষাতেও পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে গ্রাফিক নভেল ‘মুজিব’।