পাপুলের খবর সংসদকে জানাবে কে?

লক্ষ্মীপুরের এমপি শহিদ ইসলাম পাপুল অর্থ ও মানবপাচারের অভিযোগে সাত মাসের বেশি সময় কুয়েতের কারাগারে থাকলেও এ বিষয়ে ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ এখনও কিছু জানে না বাংলাদেশ।

মাসুম বিল্লাহসাজিদুল হক ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Jan 2021, 06:12 AM
Updated : 15 Jan 2021, 09:34 AM

কুয়েতে পাপুলের বিরুদ্ধে যে মামলা চলছে, তার রায় জানা যাবে ২৮ জানুয়ারি। সেখানে তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, সে বিষয়ে দেশে সবাই জানেন। কুয়েতে তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর এ নিয়ে সংসদে কথাও হয়েছে।

কিন্তু ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ কিছু জানানো হয়নি, এই যুক্তিতে পাপুলের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ এখনও নেয়নি জাতীয় সংসদ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোন সদস্য আটক হলে আটক হলে, দণ্ড হলে, জামিন হলে বা অন্য কোনভাবে মুক্তি পেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্পিকারকে জানাবেন। স্পিকার বিষয়টি সংসদে জানাবেন। সংসদ অধিবেশনে না থাকলে চিঠি দিয়ে সংসদ সদস্যদের জানাবেন। এটা কার্যপ্রণালি বিধিতে স্পষ্ট বলা আছে।

”কিন্তু কোনো কর্তৃপক্ষ আমাকে কিছুই জানায়নি। জানালে নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও একই কথা বলেছেন।

“অফিসিয়ালি কিছু জানি না। আমরা পত্রিকা মারফত জানি। এর বেশি কিছু জানি না।”

জনশক্তি রপ্তানিকারক পাপুলকে গত ৬ জুন কুয়েতের মুশরিফ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে সে দেশের পুলিশ।

মানব ও অর্থপাচার এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের শোষণের অভিযোগ আনা হয় বাংলাদেশের এই আইনপ্রণেতার বিরুদ্ধে।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর কুয়েতের অপরাধ আদালতের কাউন্সেলর আব্দুল্লাহ আল-ওসমানের আদালতে পাপুলের বিচার শুরু হয়। এরপর তদন্ত ও সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২৮ জানুয়ারি রায়ের জন্য তারিখ ঠিক করেন বিচারক।

পাপুল গত জুনে কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়ার মাসখানেক পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, এ বিষয়ে তথ্য চেয়ে কুয়েত সরকার এবং ঢাকায় কুয়েত দূতাবাসে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তখন পর্যন্ত কোনো তথ্য বাংলাদেশকে দেওয়া হয়নি।

গত অক্টোবর মাসে কুয়েত সফর করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। ওই সফর শেষে ঢাকায় ফিরে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সফরকালে কুয়েতি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পাপুলের বিষয়ে তার কোনো আলোচনা হয়নি। বাংলাদেশ তরফেও কোনো কথা তোলা হয়নি। 

এর কারণ ব্যাখ্যা করে মন্ত্রী ওই সময় বলেন, “এটা একটা ক্রিমিনাল কেস। ব্যক্তিবিশেষের বিচার হচ্ছে। উনি ওখানে কূটনৈতিক ভিসায় যাননি। উনি বা উনার পরিবার কেউ মিনিস্ট্রি থেকে পাসপোর্টও সংগ্রহ করেননি।

“স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী হিসাবে উনাকে গ্রেপ্তার করেছে, উনাকে শাস্তি দিবে। এ নিয়ে তারা আমাদের সাথে কোনো আলাপও করেনি, আমরাও তুলিনি।”

পাপুলের ‘মদদদাতা’ হিসেবে ওই সময় কুয়েতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এসএম আবুল কালামের নামও আসে। তাকে নিয়ে যে সব খবর প্রকাশিত হয়েছে, সে বিষয়ে তদন্ত করা হতে পারে বলেও তখন জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

সংসদ সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাংসদ পাপুল যদি কুয়েতের আদালতে দণ্ডিত হন, কিংবা তাকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়, সেক্ষেত্রে তার আটক বা গ্রেপ্তারের বিষয়টি স্পিকারকে জানাতে হবে। সে অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল ও তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম। ছবি: ফেইসবুক

কার্যপ্রাণি বিধিতে বলা আছে, কোনো সদস্য ফৌজদারি অভিযোগে বা অপরাধে গ্রেপ্তার হলে কিংবা কোনো আদালতে দণ্ডিত হলে বা কোনো নির্বাহী আদেশ আটক হলে, গ্রেপ্তারকারী বা দণ্ডদানকারী বা আটককারী কর্তৃপক্ষ বা জজ বা ম্যাজিস্ট্রেট বা নির্বাহী কর্তৃপক্ষ যথাযথ ফরমে গ্রেপ্তার, দণ্ডাদেশ বা আটকের কারণসহ পুরো বিষয় স্পিকারকে জানাবে।

গ্রেপ্তার হয়ে দণ্ডপ্রাপ্তির পর আপিলের বিবেচনা সাপেক্ষে জামিনে মুক্ত হলে বা অন্যভাবে মুক্ত হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একইভাবে স্পিকারকে অবহিত করবে।

ওই কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশের ভেতর কোনো এমপি গ্রেপ্তার হলে গ্রেপ্তারকারী কর্তৃপক্ষ বিষয়টি স্পিকারকে জানাবেন। নিয়ম অনুযায়ী এর আগে তাই হয়েছে। এমপি শহিদ ইসলাম যেহেতু দেশের বাইরে গ্রেপ্তার হয়েছেন, সেক্ষেত্রে আমাদের সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ থেকে বিষয়টি জানাতে হবে। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংসদে জানাবে।

“পত্রিকার খবর বা অন্য মাধ্যমে জানার বিষয় না। এখানে সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে। সেই নিয়ম অনুযায়ী সংসদকে জানাতে হবে। অর্থাৎ স্পিকারকে জানাতে হবে। এখানে সংসদ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কিছু করবে না। করার কথাও নয়।”

বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো আইনপ্রণেতা নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি আর সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হন না।

কুয়েতে পাপুলের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা প্রমাণিত হলে সে দেশের আইনে তার পাঁচ থেকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে।

ওই শাস্তি হলে পাপুলের সদস্য পদ থাকবে না। তবে পাপুলের সদস্য পদ নিয়ে কোনো বিতর্ক দেখা দিলে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।

কুয়েতের আইন অনুযায়ী শাস্তি হলে পাপুলের সদস্য পদ থাকবে কিনা জানতে চাইলে স্পিকার শিরীন শারমিন বলেন, “সেটা পরের বিষয়। তিনি আপিলও করতে পারেন। কিন্তু প্রথম বিষয় হচ্ছে, তার বিষয়টি নিয়ম অনুযায়ী স্পিকারকে জানতে হবে।”

পাপুলের বিষয়ে দূতাবাসের প্রচেষ্টায় কী ফল পাওয়া গেল জানতে সেখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল আশিকুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “দূতাবাস থেকে এ ধরনের কোনো তথ্য দেওয়া হয় না।”

সাধারণ শ্রমিক হিসাবে কুয়েত গিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়া পাপুল ২০১৮ সালে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

ওই নির্বাচনে ওই আসনটি আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু জাতীয় পার্টির প্রার্থী শেষ মুহূর্তে ভোট থেকে সরে দাঁড়ালে ‘বিএনপি ঠেকানোর’ কথা বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ পাপুলের পক্ষে কাজ করে বলে দলটির নেতাদের ভাষ্য।

পাপুল নিজে এমপি হওয়ার পর স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কোটায় পাওয়া সংরক্ষিত একটি আসনে তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামকে এমপি করে আনেন।

প্রবাসী উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন পাপুল, যেখানে তার বড় অঙ্কের শেয়ার রয়েছে।

পাপুলের মালিকানাধীন মারাফি কুয়েতিয়া গ্রুপে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি কাজ করেন বলে কুয়েতে বাংলাদেশি কমিউনিটির ধারণা।

এদিকে বাংলাদেশে দুদকও পাপুল, তার স্ত্রী, শ্যালিকা ও মেয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও মেয়ে ওয়াফা ইসলাম সেই মামলায় জামিনে আছেন।

পুরনো খবর