২০২০: মহামারীর খাঁড়ায় ঘরবন্দি রাজনীতি

“কী জমানা আইলো ভাই? একজন আরেকজনের লগে আগের মতো হাত মিলাইতে পারি না, কোলাকুলি করতে পারি না, মিছিল-মিটিং করতে পারি না, করোনা আমাদের রাজনীতির চেহারাটাই পাল্টাইয়া দিছে।”

সুমন মাহমুদ প্রধান রাজনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 Dec 2020, 03:34 AM
Updated : 24 Dec 2020, 03:40 AM

ঢাকার কেরানীগঞ্জের রাজনৈতিক কর্মী ফাতেমা বেগমের এই ভাষ্যেই ফুটে উঠল পেরিয়ে আসা ২০২০ সালের রাজনীতির চালচিত্র।

দেশের রাজনীতির মাঠ ২০১৯ সালে ছিল নিস্তরঙ্গ; তা পেরিয়ে ২০২০ সালের ‍শুরুতেই দেখা দেয় কোভিড-১৯ মহামারী। আর তাতে জীবন বাঁচাতে রাজনীতি ঢুকে যায় ঘরে। মিছিল, সমাবেশ, হাত মেলানোর মতো জনসংযোগের চেনা দৃশ্যগুলো হয়ে যায় উধাও।

মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর মহামারীর বিস্তার ঠেকাতে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর তৈরি করা হয় অবরুদ্ধ অবস্থা, যে কোনো সমাবেশের উপর আসে নিষেধাজ্ঞা।

ওই সময়টাতে রাজনৈতিক নেতাদের কাজ ঘরে থেকে বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তবে সঙ্কটে পড়া মানুষের সহায়তায় বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মীদের তৎপরতা ছিল। নেতাদের রাজপথ ছেড়ে সভা-ওয়েবিনার নিয়ে ভার্চুয়াল জগতেই বেশি সময় কাটাতে দেখা গেছে।

অন্য সব নির্বাচন বন্ধ থাকলেও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণ দেখিয়ে সংসদের কয়েকটি আসনের উপনির্বাচন মহামারীকালেও করেছে নির্বাচন কমিশন। তাতে ভোটারদের তেমন সাড়া দেখা যায়নি। বড় দলগুলোর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এসব নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়ী হয়। আর বিএনপি আগের মতোই কারচুপির অভিযোগ তোলে।

বছরের মাঝামাঝিতে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পর সরব হয়েছিল বাম দলগুলো, তবে তা মিছিল-সমাবেশ-মানববন্ধনেই সীমিত ছিল। ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় হয়ে উঠেছিল বাম দলগুলো, তবে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান সরকার করার পর সেই আন্দোলনও স্তিমিত হয়ে আসে।

বেশ কয়েক বছর পর হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে ইসলামী দলগুলো হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর কার্টুন প্রকাশ নিয়ে ফ্রান্সবিরোধী বিক্ষোভে নেমে রাজপথে উত্তাপ ছড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছিল।

তা থেমে যাওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য অপসারণের দাবি তুলে হেফাজত বছরের শেষ ভাগে রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত করে।

জুন মাসে অবরুদ্ধ অবস্থার বিধি-নিষেধ শিথিল হলে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়তে থাকলেও তা চেনা দৃশ্যে ফেরেনি। মোটামুটি সব রাজনৈতিক দলের তৎপরতা ঘরোয়া সভা, এর বাইরে কয়েকটি মানববন্ধনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

ঘরোয়া তৎপরতার মধ্যেও ভাঙন ধরেছে দুই রাজনৈতিক দল গণফোরাম ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডিতে। হেফাজতেও বাজছে ভাঙনের সুর।

শীতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো দেশেও করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে থাকায় রাজনীতির মাঠ স্বাভাবিকে কবে ফিরবে, তা নিয়ে সংশয় এখনও কাটেনি।

অস্বাভাবিক এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে দল পরিচালনার চিরচেনা কৌশল বদলে নতুন করে ভাবতে হবে বলে মনে করেন দেশের রাজনীতির দিকে চোখ রাখা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী বদর উদ্দিন ওমর।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনা রাজনীতির চালচিত্র পাল্টে দিয়েছে। অনেক কিছু নতুন করে ভাবনার সুযোগ করে দিয়েছে। কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন চলতে হবে তার শিক্ষা দিয়েছে। কীভাবে রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল বা সংগঠন পরিচালনা করতে হবে তার কর্মকৌশলও চিন্তা করতে হবে।

“আপনি সভা-সমাবেশ করবেন, সেটা পরিবেশ-পরিস্থিতি পারমিট করছে না। এর বিকল্প কী? ইন্টারনেট সিস্টেম। এখন দেখুন আমরা ভার্চুয়াল কনফারেন্স বা ওয়েবিনার করছি। এটায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমি মনে করি, আমাদের পরিস্থিতি মোকাবেলায় নতুনভাবে সব কিছু ভাববার কিংবা চিন্তার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।”

আওয়ামী লীগ

মুজিববর্ষ উদযাপনের মধ্যে দল গোছাতে বছরের শুরুতে নানা পরিকল্পনার কথা শোনালেও মহামারীর কারণে তা আর এগোয়নি।

ওবায়দুল কাদের

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনা মহামারীর প্রভাবে সারা বিশ্বে যেমন অনেক কিছুই থমকে গেছে, আমাদের রাজনৈতিক দলও তার থেকে বাইরে নয়। তবে এই বছরের বৈরী অবস্থার মধ্যেও আমাদের সভানেত্রী গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলীয় কার্যক্রম আমরা সুচারুরূপে পরিচালনা করতে পেরেছি।”

ক্ষমতাসীন দলটির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্য কয়েকটি পদ পূরণ করা হয়েছে, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা ও মানবসম্পদ উপকমিটি গঠিত হয়েছে।

দলের সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, মহিলা লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়েছে।

টানা এক যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে অনেক ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটেছে বলে দলটির নেতারাই স্বীকার করছেন। সেই অনুপ্রবেশকারীদের বের করে দিতে নেতারা ‍মুখে অনেক কথা বললেও কাজে তা দেখা যায়নি।

নতুন বছরে সাংগঠনিক কাজে গতি আনার আশা করছেন ওবায়দুল কাদের।

তিনি বলেন, “করোনাকালের মধ্যে যেসব বিষয়ে আমরা করতে পারিনি, তা আগামী বছর আরও গতিশীল করে সম্পন্ন করতে পারব। আমার বিশ্বাস, আগামী বছরে আমাদের সাংগঠনিক তৎপরতা কমবে না, আরও বাড়বে।”

বিএনপি

গত বছর বিএনপির কর্মসূচি ঘুরপাক খাচ্ছিল দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি নিয়ে। জোরাল কোনো কর্মসূচি না থাকলেও কর্মীদের চাপ ছিল।

তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে আকস্মিকভাবেই সরকার নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেন দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত খালেদা জিয়াকে। তিনি এখন তার বাড়িতেই রয়েছেন; শীর্ষ নেতারা দুই ঈদে তার সাক্ষাৎ পেলেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তিনি অনুপস্থিত।

বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রমও তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি গঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়েছে। ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) ছাড়া সব সহযোগী সংগঠনের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছে।

এক যুগের বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির অভ্যন্তরে নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের খবর মাঝেমাঝে আসছে। এর মধ্যে বছরের শেষভাগে দুই ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও শওকত মাহমুদকে শোকজ নোটিস দেওয়া ছিল আলোচিত।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের একদিকে ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। এসব নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা সংগঠনকে শক্তিশালী করতে তৃণমূলসহ সব পর্যায়ে কমিটি গঠনের কাজ করেছি। এখনও সেই প্রক্রিয়া চলমান।

“আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন জনাব তারেক রহমান তৃণমূল পর্যায় থেকে কমিটি গঠন প্রক্রিয়ার কার্যক্রম সরাসরি তদারক করছেন। আমরা মনে করি, বিএনপি অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় সাংগঠনিকভাবে বেশি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ।”

সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা বললেও দৃশ্যমান কিছু করতে না পারার বিষয়ে ফখরুল গত এক দশকে বিএনপির ৩৫ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা ও নিপীড়ন-নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে বলেন, “আমরা এক দুঃসময় অতিক্রম করছি।”

জাতীয় পার্টি

সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি তাদের কাণ্ডারি এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পর অনেকটাই ম্রিয়মান। বছরের শুরুতে কাউন্সিলের পর তৃণমূলে ঘর গোছানোর কাজ শুরু করলেও মহামারীতে সে কাজ থমকে যায়।

কাউন্সিলে মহাসচিব হয়েছিলেন মশিউর রহমান রাঙ্গাঁ। কিন্তু মধ্যভাগে জুলাই মাসে মহাসচিব পদ থেকে তাকে সরিয়ে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে বসানো হয়।

জি এম কাদের

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনার প্রকোপে স্বাভাবিক সাংগঠনিক কাজ-কর্ম ব্যাহত হয়েছে। তারপরও আমরা ঘর গোছানোর কাজ করেছি নানা প্রতিকূলতার মধ্যে।”

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তিনি বলেন, “মহামারীর দ্বিতীয় ধাপে অনেক মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। সেই আশঙ্কা থেকেও আমাদের সামনে এগোতে হবে। তারপরও আমরা আমাদের সংগঠনকে তৃণমূল পর্যায় থেকে শক্তিশালী করার কাজটি করে যাব-এটাই আমাদের লক্ষ্য।”

অন্যান্য

কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে বিভেদ দেখা দেয় বছরের শুরুতে। এক পক্ষের নেতৃত্বে কামাল হোসেন ও রেজা কিবরিয়া; অন্য পক্ষে মোস্তফা মহসিন মন্টু, আবু সাইয়িদ ও সুব্রত চৌধুরী। তবে বছর শেষে এসে কামাল হোসেন আবার দুই পক্ষকে এক করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

বাসদের কর্মসূচি

আ স ম আবদুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডিও দুই ভাগ হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন রবের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে জেএসডি (রতন) নামে নতুন ঠিকানা খুলেছেন।

অন্য সব দলের মতো সিপিবি, বাসদসহ বাম দলগুলোর তৎপরতা ঘরোয়া বৈঠক, মানববন্ধনে সীমিত ছিল। পাটকল বন্ধের প্রতিবাদে বাম গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত দলগুলো সরব ছিল। ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনেও সক্রিয় ছিল দলগুলো।

ডাকসুর সাবেক ভিপি ‍নূরুল হক নুর নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়ে আলোচনায় এলেও তা এখনও প্রকাশ্য হয়নি। তবে কয়েকটি দলের সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দেখা গিয়েছিল তাকে।

রাজপথে হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

ফরাসি সাময়িকীতে হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের পর তা কেন্দ্র করে রাজপথে সক্রিয় হয়েছিল হেফাজতে ইসলাম। আর তার মধ্য দিয়ে ইসলামী দলগুলোর সক্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা দেখা যায়। এর মধ্যে হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতের মধ্যে বিভাজন দেখা দিয়েছে।

বছরের শেষ ভাগে এসে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতায় সরব হন হেফাজতে ইসলামের কয়েকজন নেতা। তা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বাদ-প্রতিবাদের ঝড় তোলে।

তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আলোচনার মধ্য দিয়ে এই বিরোধিতার অবসান ঘটাতে চাইছে; অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সর্বশেষ আলোচনায় হেফাজত নেতাদেরও নরম সুর শোনা গেছে।