বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের ‘অন্যায্য দাবি অগ্রাহ্য করেন’ বঙ্গবন্ধু

ফিরে আসা লাখ লাখ শরণার্থীর বন্দোবস্তের পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনঃগঠনে বঙ্গবন্ধু কী কী নীতি নিয়েছিলেন, কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে তাকে পড়তে হয়েছিল- সেই সব বিষয় উঠে এলো একটি আলোচনা সভায়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Nov 2020, 08:57 PM
Updated : 20 Nov 2020, 08:57 PM

স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা নিয়ে শুক্রবার রাতে আয়োজিত এক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং স্কলার গবেষক রওনক জাহান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামনিস্ট সৈয়দ বদরুল আহসান এবং তরুণ লেখক ও গবেষক হাসান মোরশেদ এসব বিষয় তুলে ধরেন। আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা উপকমিটি আয়োজিত ওয়েবিনারের এই পর্ব সঞ্চালনা করেন দলটির অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক ওয়াসিকা আয়েশা খান।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে আরও বেশি মানসম্মত গবেষণায় মন দিতে তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহ্বন জানান রওনক জাহান।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে তরুণ সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করা মসিউর রহমান সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, “স্বাধীনতার পরপরই এবং বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার আগেই ভারত সরকার সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন লিঁয়াজো অফিসার্স (সিএএলও) নামে আমাদের প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য কিছু সরকারি কর্মকর্তা দিয়েছিল। ইন্ডিয়ান প্ল্যানিং কমিশনের মেম্বার সুখময় চক্রবর্তী বিষয়টি সমন্বয় করতেন। তারা যখন দেখলেন নতুন দেশের পক্ষে কাজ করার মতো প্রশাসনে পর্যাপ্ত লোকবল রয়েছে তখন এখান থেকে তাদের উঠিয়ে নেওয়া হল।

“এছাড়া এখানে শান্তি-শৃংখলা রক্ষার জন্য কিছু দিন পর্যন্ত ইন্ডিয়ান সৈন্যবাহিনীর কিছু অংশ ছিল। বঙ্গবন্ধুর একান্ত প্রত্যয় বা সাহসের বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করে সেনাবাহিনীকে ফিরে যেতে বাধ্য করেন।”

প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান বঙ্গবন্ধু সরকার আমলে তরুণ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন।

স্বাধীনতার পর ত্রাণ ও ঋণ সহায়তা নিয়ে আসা বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ও ইউএসএইডের বিভিন্ন ‘অন্যায় অন্যায্য’ দাবি এবং চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে বঙ্গবন্ধু তা দৃঢ়তার সঙ্গে অগ্রাহ্য করেছেন বলে জানান মসিউর রহমান।

  তিনি বলেন, “রিলিফ ব্যবস্থাপনা ছিল একটা জটিল কাজ। বঙ্গবন্ধুকে এই কাজ দিয়েই রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাজে হাত দিতে হয়েছিল। বিশ্ব ব্যাংক থেকে পাকিস্তানের নেওয়া ঋণদায় অন্যায়ভাবে বাংলাদেশর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। ‍তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার আবেদনে লাখ লাখ বাঙালি প্রাণ দিয়েছে। এখন আবার যদি আবেদন করি তারা না খেয়ে থাকবে। তবুও তোমাদের অন্যায় আবদার মেনে নেওয়া হবে না।”

পরে বিশ্ব ব্যাংকের কিছু ন্যায় সঙ্গত ঋণদায়ের প্রস্তাব বঙ্গবন্ধু মেনে নিয়েছিলেন বলেও জানান তিনি।

ভূমি ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে চীন ও রাশিয়ার অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে বঙ্গবন্ধু সমবায় ও কো-অপারেটিভ পদ্ধতি চালু করেন বলে জানান তৎকালীন প্রশাসনের এই কর্মকর্তা।

“বিভিন্ন ঋণ ও অর্থ সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে ডিভ্যালুয়েশনের প্রস্তাব দেয় আইএমএফ। বঙ্গবন্ধু তখন বাধ্য হয়ে ওই প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন। তবে তিনি নিজের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে সেখানে একটি শর্ত জুড়ে দেন। তাহল যখন নতুন ফসল বাজারে আসে তখনই ডিভ্যালুয়েশন বাস্তবায়ন করতে হবে, এর আগে নয়। তার আশা ছিল, তখন পণ্যের দাম নিম্নমুখী থাকে। ফলে বাজারে এর প্রভাব তুলনামূলক কম পড়বে।”

শিল্প কারখানা জাতীয়করণের যৌক্তিকতা তুলে ধরে মসিউর রহমান বলেন, “সেই সময় রপ্তানির ৭০ ভাগ আসত জুটমিল থেকে। বেশিরভাগ মিলের মালিক ছিল অবাঙালি। জুটমিলগুলো ছিল এর অংশ। মূলত জাতীয়করণটা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনেরই একটি অংশ। কারণ যাদের কাছ থেকে স্বাধীনতা আনছি তারাই ছিল এগুলোর মালিক।”

রওনক জাহান বলেন, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ভঙ্গুর অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কাজেও হাত দিতে হয়েছিল। স্বাধীনতার আগে বড় বড় শিল্প-কারখানাগুলো সব ছিল পাকিস্তানিদের দখলে। তখন ফরেন রিজার্ভ বলতে কিছুই ছিল না। প্রশাসনে যেসব লোকজন ছিল তারা বয়সে তরুণ ছিল।

“বাংলাদেশই প্রথম একটা স্বাধীন দেশ যে পোস্ট কলোনিয়াল স্টেট সিস্টেমকে ভেঙে নতুন দেশ হয়েছে। সেই সময় এটা ছিল একটা ইউনিক ব্যাপার। এখন সভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে বিভিন্ন রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার পর স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের বিষয়টি হয়ত স্বাভাবিক ঘটনা হয়েছে। তখন শুধু পশ্চিমা বিশ্ব নয়, তৃতীয় বিশ্বের দেশ, ইসলামি দেশগুলোও আমাদের পক্ষে ছিল না। কারণ তারা ভেবেছিল এতে করে নিজেদের দেশেও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে।”

গবেষক রওনক জাহানের কথায় উঠে এসেছে স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী আচরণের কথা।

যুক্তরাষ্ট্রের অনড় অবস্থান স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমেরিকা তখন ছিল বিশ্বের অনেক বড় খাদ্য সহায়তা দানকারী দেশ। ’৭২ সালের দিকে আমেরিকা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে খাদ্য সহায়তা দিলেও বিপত্তিটা ঘটে ’৭৩ সালে এসে। তখন বাংলাদেশ খাদ্য কিনতে চাইলেও তারা দিতে চাচ্ছিল না। তারা কারণ হিসাবে দেখিয়েছে কিউবায় পাট বিক্রি করার বিষয়টি। সে কারণেই ১৯৭৪ সালে এই দেশে দুর্ভিক্ষটা হয়েছিল।”

বিশ্ব ব্যাংকের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে দেশীয় কর্মীরাই স্বাধীনতার এক বছরের মাথায় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করে দিয়েছিলেন জানিয়ে অধ্যাপক রওনক বলেন, “দেশ যখন স্বাধীন হলো তখন দেশের নেতৃত্বে তরুণরাই ছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি ছিলেন। তিনি অনেকগুলো নীতি হাতে নিয়েছিলেন। তারপর যখন দেখেছেন কিছু নীতি কাজ করছে না সেগুলো বাদ দিয়েছেন। তিনি ছিলেন প্রাকটিক্যাল। তিনি নিজেই নিজের কিছু নীতির পরবর্তন আরম্ভ করে দিয়েছিলেন।

“নতুন প্রজন্মের গবেষকদের এগুলো ঘেঁটে দেখতে হবে। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশকে নিয়ে গবেষণার কাজে নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। নির্মোহভাবে, সাহস করে মুক্ত মণ নিয়ে এসব বিষয়ে গবেষণা করতে হবে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভালো গবেষণা নেই। তার সবচেয়ে ভালো জীবনীগ্রন্থটি তার নিজের হাতেই লেখা।”

“বঙ্গবন্ধু দেশের পুনর্গঠনের জন্য এত পরিশ্রম করলেও ’৭৪ সালে দেশ একটি দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছিল। দেশটা যে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সেটা আর কটাদিন বেঁচে থাকলেই তিনি নিজের চোখে দেখতে পেতেন। ঘাতকেরা তাকে দেখতে দিল না।”

তরুণ লেখক ও গবেষক হাসান মোরশেদ বলেন, “অনেকটা শূন্য হাতেই যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কাজে হাত দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ত্রাণ ও পুনর্বাসনকে অগ্রাধিকার দিয়েই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির যাত্রা শুরু করিয়েছিলেন। কারণ যুদ্ধের কারণে বিধ্বস্ত হওয়ার আগেও বাংলাদেশে বড় ধরনের বন্যা হয়েছিল। সেই বন্যার কারণে ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে কৃষি অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। তখন অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৬৫ শতাংশ আসত কৃষি থেকে।

“৭২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়টা ছিল পুনর্বাসনের সময়। ভারত থেকে ফিরে আসা শরণার্থীদের জন্য তখন ৪৩ লাখ বাসগৃহ নির্মাণ করা হয়েছিল। এছাড়া তাদেরকে খাদ্য সরবরাহ করতে হয়েছিল। তখন তৃণমূল পর্যায়ে রাজনৈতিক কর্মীদের কাজে লাগিয়ে এই ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছিল।”

প্রথম ছয় মাস পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কাজে যুক্ত হয় রিকনস্ট্রাকশন বা পুনঃনির্মাণ; তখন বাজেট ঘোষণা করা হয়। প্রথম বাজেটের নাম ছিল বাজেট ফর রিকনস্ট্রাকশন।

মাত্র এক বছরের মধ্যে ৫৯ মাইল রেললাইন পুনঃনির্মাণ, ৮২টি রেল ব্রিজ মেরামত করা হয়, সড়ক, সড়ক সেতু মেরামত করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাইন অপসারণ করা হয়। প্রচণ্ড রকমের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল সমবায় পদ্ধতিতে এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি যুক্ত করা হয়। ১৯৭২ সালে সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প চালু করেন বঙ্গবন্ধু। সেই প্রকল্পের আওতায় সর্বপ্রথম ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ শুরু হয়। ১৯৭৪ সালে চালু হয় সমবায়ভিত্তিক মিল্ক ভিটা।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামনিস্ট সৈয়দ বদরুল আহসান বলেন, “স্বাধীনতার পর পর আমাদের তিন হাজার মণ গম, দুই হাজার মণ বোরো ধান বীজ প্রয়োজন ছিল। ত্রিশ হাজার টন সার দরকার ছিল, ১৫ লাখ টন আলু বীজ দরকার ছিল বলে তখন বিশ্ব ব্যাংক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু সরকার কী একটা চাপ মাথায় নিয়ে সরকার গঠন করেছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মাথায় নিয়েই প্রথম বছর অতিক্রম করতে হয়েছে।”

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১২ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন তিনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে নানামু্খী পরিকল্পনার পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যার সুফল এখনও পাচ্ছে বাংলাদেশ।

অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেইসবুক পেইজ ও ইউটিউবে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়। এতে সার্বিক সহযোগিতা করেছে দলের গবেষণা উইং সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)।