বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নামে সেনাপদবী ব্যবহার না করার আহ্বান

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের নামের আগে সেনাপদবী ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছেন সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Nov 2020, 06:08 PM
Updated : 11 Nov 2020, 06:54 PM

বুধবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে আনা সাধারণ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় তিনি এ দাবি করেন। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানাতে ১৪৭ বিধিতে সাধারণ প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

আবদুল মতিন খসরু (ফাইল ছবি)

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুল মতিন খসরু বলেন, “কত নিকৃষ্ট মানুষ! বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল। সেই খুনির বিচার করা যাবে না, ইনডেমনিটি দিল। কোথাও এই আইন আছে? জিয়াউর রহমান খুনিদের রাষ্ট্রদূত বানিয়েছে। বেগম জিয়া জানে না রশীদ খুনি? রাসেলের খুনিকে তিনি চেনেন না? খুনিকে বিরোধী দলের চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। খালেদা জিয়া অপরাধী। তারা ডকট্রিন অব ইমপিউনিটি চালু করেছিল। জিয়া এবং বেগম জিয়া বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে রেগুলার যেতেন। বঙ্গবন্ধু একটু তাকালে তারা খুশি হয়ে যেতেন।

“বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বুক ফুলিয়ে হাঁটত। আর জীবনে দেশে আসতে পারবে না। এদের নামের সাথে কর্নেল ব্রিগেডিয়ার থাকা উচিত না। আমাদের সেনাবাহিনী আমাদের গৌরব। তাদের নামের আগে ওসব থাকা উচিত না।”

কমিশন গঠন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তাদের আইনের আওতায় আনতে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আওয়ামী লীগ নেতা খসরু।

বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা দিক তুলে ধরে সাবেক সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, “বঙ্গবন্ধু কখনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। অজপাড়া গাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই সত্য কথা বলতেন। তিনি যদি ’৭০ এর নির্বাচনে না যেতেন তাহলে ইতিহাস এ রকম হত না। তিনি ম্যান্ডেট পেলেন। এই একটা সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে আব্দুল মতিন খসরু বলেন, “বিচক্ষণ দৃঢ় নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। বঙ্গবন্ধু নাই, তার আদর্শ-চেতনা সেটা তার কন্যা শেখ হাসিনা করছেন। তার সাথে কার তুলনা হয়, খালেদা জিয়া? বিএনপিকে জিজ্ঞাসা করলেও বলে না। বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ শেখ হাসিনার নেতৃত্ব। এটা তোষামদি নয়, বাস্তবতা। বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতা ছিল ঐশ্বরিক। আজ বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তিনি শেখ হাসিনাকে বলতেন, মা তুমি প্রধানমন্ত্রী হও। এটা তোষামদি নয়, বাস্তবতা।”

বঙ্গবন্ধু বেসরকারি খাতের ‘পক্ষে ছিলেন’

সালমান এফ রহমান (ফাইল ছবি)

আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য সালমান এফ রহমান বলেন, “অনেকে মনে করে বঙ্গবন্ধু বেসরকারি খাতের পক্ষে ছিলেন না। এটি সত্য নয়। স্বাধীনতার পর ফরেন এক্সচেঞ্জ ছিল না। ফলে বাণিজ্য করতে হত বার্টার সিস্টেমে। কিছু পণ্য রপ্তানির বিপরীতে আমদানি হত। যখন বেক্সিমকো শুরু করলাম আমাদের প্রস্তাবে রাজি হলেন। তবে শর্ত দিলেন ৬০ শতাশ প্রচলিত পণ্য রপ্তানি করতে পারব। বাকি ৪০ শতাংশ অপ্রচলিত পণ্য। পাট চামড়া আর চিংড়ি এগুলো ছিল অপ্রচলিত পণ্য। তখন চা-কে রপ্তানিপণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন বঙ্গবন্ধু। ওষুধ সার কীটনাশক এনেছি। তখন থেকেই রপ্তানি বহুমুখীকরণের গুরুত্ব বঙ্গবন্ধু বুঝেছিলেন। সেটা বাস্তবায়নের জন্য বেসরকারি খাতকেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

“বেশিরভাগ শিল্পের মালিক ছিল পাকিস্তানিরা। বঙ্গবন্ধু শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করে সেগুলোর প্রশাসক নিয়োগ দিলেন আমাদের। পরিচালনার দায়িত্ব আমাদের হাতেই থাকল।”

সালমান এফ রহমান বলেন, “আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বঙ্গবন্ধুর মতো বেসরকারি খাতরে ওপর বিশ্বাস রাখেন। বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন তবে এতদিন সোনার বাংলা গড়ে তুলতেন। আমাদের সৌভাগ্য আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া স্বপ্ন পূরণে হাল ধরেছেন তিনি, এই দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করবেন।”

আইনমন্ত্রীর স্মৃতিচারণা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে নিজের জীবনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী ও বন্ধু প্রয়াত সিরাজুল হকের ছেলে আনিসুল হক তার ছাত্রজীবনে তাদের বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর যাওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিজের স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “১৯৬৯ সাল, তখন বয়স আমার সাড়ে ১৩ বছর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের মোহাম্মদপুরের বাসায় আসলেন। মনটা আমার উৎফুল্ল হয়ে গেল। আসার হেতু আমার পিতা তার বন্ধু ও আইনজীবী। সেই দিন বা তার দুই-একদিন আগে পাকিস্তান সরকারের একটি মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নির্দোষ প্রমাণিত করে কোর্ট খালাস দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু একটি টয়োটা গাড়িতে করে আমাদের বাড়ি পৌঁছালেন। আমার পিতার সাথে কোলাকুলি করার পরে একটি মিষ্টির প্যাকেট হাতে দিয়ে বললেন, উকিলের বাসায় খালি হাতে আসা উচিত নয়। তুই তো ফি নিবি না, তাই এক প্যাকেট মিষ্টি এনেছি।

“তিনি ভেতরে গিয়ে বসলেন। তারপর যখন চা আসল, চায়ের সঙ্গে গুড়ের সন্দেশও উনার জন্য দেওয়া হল। আমি ওনার পাশেই ছিলাম। উনি সন্দেশের বাটিটা হাতে নিয়ে আমাকে বললেন, ‘তুই নে।’ আমি বললাম, আগে আপনি নেন। জবাবে আমাকে বললেন, ‘তুই যদি না নিস তাহলে পুরো বাটিটা মাটিতে ফেলে দেব।’ তখন তাড়াতাড়ি করে আমি একটা সন্দেশ নিলাম। উনিও একটা নিলেন। যাওয়ার সময় আমার পিতাকে জিজ্ঞাসা করলেন, সাংবাদিক এবিএম মুসার বাড়ি নাকি তোর বাড়ির কাছেই? আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আমার ছদ্মনাম ছিল পরশ। ওর ছেলের নামও নাকি পরশ রেখেছে। তাকে একুট দেখে যাব।”

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক (ফাইল ছবি)

বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছার আপসহীন অবস্থানের কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আইনজীবী আনিসুল হক বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গমাতাকে যখন বেডরুম থেকে নিয়ে আসা হচ্ছিল এবং সিঁড়ির কাছে এসে যখন বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখছিলেন তখন ঘাতকদের বলেছিলেন, ‘আমাকে এখানেই মেরে ফেল। আমি আর কোথাও যাব না।’ মৃত্যুর মুখে পড়লে মানুষ স্বাভাবিকভাবে বাঁচার চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বঙ্গমাতার ভালোবাসার নিদর্শন তিনি মৃত্যুর সময়ও দেখিয়ে গেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর মতো মৃত্যুকে ভয় পাননি। খুনিদের কাছে জীবন ভিক্ষা চাননি। আদর্শের ব্যাপারে আপস করেননি। এটাই বঙ্গবন্ধু, এটাই বঙ্গমাতা। এটাই বঙ্গবন্ধুর পরিবার। তারা নীতিতে অবিচল, আদর্শে অটল।”

আইনমন্ত্রী বলেন, “বঙ্গবন্ধুর প্রত্যেকটি পদক্ষেপই শিক্ষণীয়। আইনের শাসনের প্রতি তার ছিল অগাধ বিশ্বাস। আদালতের প্রতি ছিল গভীর আস্থা। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় তার ছিল দৃঢ়তা। নিজের অভিজ্ঞতার উপলব্ধি দিয়ে বুঝেছিলেন মানুষের দুর্দশা লাঘবের শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে আদালত। এ কারণে তিনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিয়ে সংবিধানে স্থান দিয়েছিলেন। জনগণের যাতে দুর্ভোগ পোহাতে না হয় তার জন্য তিনি সংবিধানে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের কথা বলেছেন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের স্বাধীনতার কথা নিশ্চিত করে গিয়েছেন।  বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই স্বাধীনতা ও পৃথকীকরণ স্বপ্নই রয়ে গিয়েছিল। মাজদার হোসেনের রায়ের পথ ধরে ২০০০ সালে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ হয়। কিন্তু পৃথক অবকাঠামো না থাকায় তা সম্পূর্ণ কার্যকর হতে পারেনি।

“বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার সারা বাংলাদেশে ভবন নির্মাণ, বেতন বৃদ্ধি, গাড়ি সরবরাহ করে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ অর্থবহ করেছেন। জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ সুগম করেছেন।”

আলোচনায় ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, “অনেক বেদনার সাথে বলতে হয়, যে মহান নেতা এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য জীবনের বেশিরভাগ সময় করাগারে কাটিয়েছেন, পরাধীন জাতিকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ উপহার দিয়েছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংস্তুপের উপর দণ্ডায়মান একটি দেশকে উন্নত সমৃদ্ধ করতে নিরলস কাজ করেছেন, সেই অবিসংবাদিত নেতাকে এদেশের কিছু বিশ্বাসঘাতক বাঁচতে দেয়নি।

“’৭৫ এর ১৫ অগাস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে একটি জাতিসত্তাকে। আর সেই পাপিষ্ঠ বিশ্বাসঘাতকদের পাপের ফল ভোগ করেছে এই বাঙালি জাতি দীর্ঘ ২১ বছর।”

শেখ ফজলুল করিম সেলিম (ফাইল ছবি)

আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, “অনেকে বলে, বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রভাষার জন্য কিছু করে নাই। তাদের বলি, ইতিহাস পড়। ২১ ফেব্রুয়ারি যখন রফিক-সালামদের হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু তখন ফরিদপুর জেলে অনশন করছেন। বঙ্গবন্ধুর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। তাকে অনশন ভাঙার জন্য বলা হয়। তিনি করেননি। পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।”

ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার অপচেষ্টা তুলে ধরে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করল। বিজয় দিবস স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করত না। ইতিহাসকে চাপা দেওয়া যায় না। জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু অনেক বেশি শক্তিশালী। যতদিন বাংলাদেশ ততদিন বঙ্গবন্ধু। তার শারীরিক মৃত্যু হতে পারে, কিন্তু আদর্শের মৃত্যু হবে না।”

অন্যদের মধ্যে আলোচনায় আরও অংশ নেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের মৃনাল কান্তি দাস, আবদুস সোবহান মিয়া, নজরুল ইসলাম বাবু, জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।