নূর হোসেনের আশা পূরণ হয়নি: জিএম কাদের

যে আশায় নূর হোসেন আত্মদান করেছিলেন, এইচ এম এরশাদের পতন ঘটলেও তার সেই আশা পূরণ হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত এই সামরিক শাসকের ভাই জিএম কাদের।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Nov 2020, 06:34 PM
Updated : 10 Nov 2020, 06:34 PM

মঙ্গলবার ঢাকার বনানীতে নিজের জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ‘গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে এক আলোচনা সভায় তিনি এই মন্তব্য করেন বলে দলটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে।

জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, “যে আশা নিয়ে নূর হোসেন আত্মদান করেছেন, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।

“নূর হোসেন হয়ত চেয়েছিলেন পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলের গণতন্ত্রের চেয়ে আরও ভালো গণতন্ত্র পাবে দেশ। এই আশায় বুকে ও পিঠে লিখেছিল- ‘স্বৈরতন্ত্র নিপাক যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। গণতন্ত্র কি মুক্তি পেয়েছে?”

১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদের পতন ঘটলেও সেই আন্দোলনের নতুন মাত্রা দিয়েছিল ১৯৮৭ সালের ১০ ডিসেম্বর নূর হোসেনের আত্মদান।

তিন জোটের ঢাকা অবরোধ চলাকালে পরিবহন শ্রমিক নূর হোসেন বুকে-পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক-গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে মিছিলে নেমেছিলেন আওয়ামী লীগকর্মী নূর হোসেন; বুকে নিয়েছিলেন সামরিক শাসকের বুলেট।

তখন শামসুর রাহমানসহ কবিদের লেখনীর বিষয় হয়ে উঠেছিল নূর হোসেন। জিপিওর সামনে যে স্থানটিতে নূর হোসেন মারা গিয়েছিলেন, সেই স্থানটির নাম হয়েছে নূর হোসেন স্কয়ার। ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবস হিসেবে পালন করে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল।

সেই দিনে এরশাদের দল জাতীয় পার্টি যে ‘গণতন্ত্র দিবস’ উপলক্ষে আলোচনা করেছিল, তারও রয়েছে ইতিহাস।

১৯৮৭ সালের তিন বছরের মাথায় গণঅভ্যুত্থানে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হন এরশাদ; দুদিন পর তার ক্ষমতাচ্যুতির মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র ফেরে বাংলাদেশে।

এরশাদ পতনের দিনটি অন্য রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রে ফেরার দিন হিসেবে পালন করলেও জাতীয় পার্টি দিনটি পালন করে ‘গণতন্ত্র দিবস হিসেবে’, এরশাদ দাবি করতেন, গণতন্ত্র ‘রক্ষার জন্য’ সেদিন ক্ষমতা ছেড়েছিলেন তিনি।

জিএম কাদের বলেন, “তিন জোটের রুপরেখা অনুযায়ী পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা হস্থান্তর করেন। কিন্তু ৯১ সালের নির্বাচনের পর তিন জোটের রুপরেখা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়।

“তবে সংবিধানের ৭০ ধারা সংসদীয় পদ্ধতির মূল স্বাদ নষ্ট করেছে। ৭০ ধারা অনুযায়ী সরকার দলীয় সদস্যরা সরকারি দলের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যে দল সরকার গঠন করে, সেই দলের প্রধানই সংসদীয় দলের নেতা এবং সরকার প্রধান হন। সরকার প্রধান যে সিদ্ধান্ত নেন, সেটাই বাস্তবায়ন হয়। এতে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়।

“ফলে স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক না হয়ে স্বৈরতন্ত্র মুক্তি পাক ও গণতন্ত্র নিপাত যাক হয়ে দাঁড়িয়েছে কি না এটাই এখন প্রশ্ন।”

সংবিধান থেকে ৭০ ধারা উঠিয়ে নেওয়ার দাবি জিএম কাদের ধারাবাহিকভাবেই করে আসছেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে দলের চেয়ারম্যানকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে যে বিধি রয়েছে, তা উঠিয়ে দিতে দলের তৃণমূলের দাবি থাকলেও তাতে তিনি নিশ্চুপ।

আলোচনায় জিএম কাদের বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বাংলাদেশের মানুষ কখনও ভুল করে না। বাংলাদেশের মানুষ কখনও ভুল মানুষকে নির্বাচিত করেনি। প্রকৃত গণতন্ত্র নিশ্চিৎ হলে রাষ্ট্রের সকল স্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিৎ হবে।

“জবাবদিহিতা নিশ্চিৎ হলে দেশে সুশাসন নিশ্চিত হবে যাতে সামাজিক ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ থাকব। প্রতি বছর গণতন্ত্র দিবসে এই হবে আমাদের অঙ্গীকার। “

আলোচনা সভায় জাতীয় পার্টি মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, “গণতন্ত্র আজ সোনার হরিণ, গণতন্ত্র আজ খাঁচায় বন্দি। জাতীয় পার্টিই পারবে প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে।”

সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত দুটি উপনির্বাচন নিয়ে বাবলু বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচনে ভোট পড়েছে মাত্র ১০ ভাগ। যেখানে ৯০ ভাগ ভোটারই ভোটাধিকার প্রয়োগ করেনি। আবার আরেকটি আসনে ভোট পড়েছে মাত্র ২ ভাগ।

“নির্বাচন কমিশন কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে? দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না।”

আ. লীগ ও বিএনপি নব্য স্বৈরাচার: বাম জোট

নব্বইয়ের গণআন্দোলনের মুখে এরশাদের পতনের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে মানুষের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষাকে ‘পদদলিত’ করে ‘নব্য স্বৈরাচারে’ পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা।

নূর হোসেন দিবসে মঙ্গলবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতনের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সিপিবি সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহ আলম, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বজলুর রশীদ ফিরোজ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, বাসদের (মার্কসবাসী) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মানস নন্দী।

সমাবেশে বাম নেতাদের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বাম জোটের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, “অসংখ্য মানুষের আত্মদান, পঙ্গুত্ববরণ, জেলজীবনের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু যারা ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের পর ক্ষমতাসীন হয়েছে সেই আওয়ামী লীগ-বিএনপি এবং তাদের জোট মানুষের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের আকাঙক্ষাকে পদদলিত করেছে। তারা নব্য স্বৈরাচারে পরিণত হয়েছে।”

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দেশে ‘কর্তৃত্ববাদী, ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন চাপিয়ে দিয়েছে’ বলেও সমাবেশে অভিযোগ করেন বাম নেতারা।

নূর হোসেন দিবসে বাম দলগুলো সকালে জিরো পয়েন্টে নূর হোসেন চত্বরে ফুলে দিয়ে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।

ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষে ফুল দেন পলিটব্যুরো সদস্য আনিসুর রহমান মল্লিক, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জাকির হোসেন রাজু, মোস্তফা আলমগীর রতন, ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতি আবুল হোসাইন।