করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থ সিদ্ধি হয়েছে: সংসদে মেনন

করোনাভাইরাসের টিকা নিয়ে ‘ব্যবসায়িক স্বার্থ সিদ্ধি’ হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Nov 2020, 05:05 PM
Updated : 10 Nov 2020, 05:23 PM

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে আনা সাধারণ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় তিনি এ অভিযোগ তোলেন। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানাতে ১৪৭ বিধিতে সাধারণ প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

মুজিববর্ষে সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করতে হলে শোষিতদের পক্ষে দাঁড়াতে হবে মন্তব্য করে মেনন বলেন, “এই কোভিড কালেও উন্নয়নের পথে দেশ থাকলেও সমাজে অসমতা বেড়ে যাচ্ছে। গরিব মানুষ আরও গরিব হচ্ছে। কোটিপতি আরও ধনাঢ্য হচ্ছে। করোনার ভ্যাকসিন নিয়েও ব্যবসায়িক স্বার্থ সিদ্ধি হয়েছে। এর বিরুদ্ধে না দাঁড়াতে পারলে মুজিববর্ষে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো আমাদের হবে না।”

আওয়ামী লীগের জোট শরিক দলের নেতা মেনন বলেন, “বাংলাদেশ পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু এই সংসদে দাঁড়িয়ে কেবল সংবিধান প্রদান করেননি, তিনি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার পথনির্দেশ দিয়েছিলেন। এটা ছিল আমাদের জাতির মূল লক্ষ্য। যেটাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছিল জিয়াউর রহমানের আমলে। এরশাদের আমলে। এরপর পঞ্চদশ সংশোধনীতে এটি পুনর্বহাল করা হলেও… আমি একটি কথা বলতে চাই- এই দুটি বিষয় আমাদের ভাববার সময় আছে। এটা কি আমরা শুধু কাগজে রাখব? নাকি বাস্তবে পরিণত করব?”

সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু তার শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি হলেন। তিনি তার শেষ ভাষণে এই সংসদে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, বাংলাদেশে ধর্মের রাজনীতি আর হবে না। আর চলতে দেওয়া হবে না। এ বিষয়ে তিনি বার বার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন।

“আজকে মুজিববর্ষে এটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। যখনই আমরা দেখি ইউটিউবে ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি’ তার ধর্মীয়করণ করা হচ্ছে। যখন দেখি আজকে হেফাজত থেকে বলা হচ্ছে, তাদের স্বার্থে দেশ চালাতে হবে। দেখি ব্লাসফেমি আইনের নতুন করে দাবি। বঙ্গবন্ধুকে সত্যিকার অর্থে শ্রদ্ধা জানাতে চাইলে এটাকে প্রাসঙ্গিকভাবে দেখতে হবে।”

১৯৭৪-৭৫ সময়কালের বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার প্রসঙ্গ টেনে রাশেদ খান মেনন বলেন, “ওই সময় তিনি দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে কঠিন ও কঠোর বক্তব্য রেখেছিলেন। হুঁশিয়ার করেছিলেন। আজকে আমার দেশে যখন দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ধারার প্রসার হচ্ছে তখন প্রধানমন্ত্রী এর বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছেন। এতে সন্দেহ নেই। সমস্ত সমাজে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ও সমাজকে রুখে দাঁড়াতে হবে।”

মেনন বলেন, “বঙ্গবন্ধু কেবল আওয়ামী লীগের নয়। বঙ্গবন্ধু কেবল দলের নয়। বঙ্গবন্ধু জাতির। তিনি জাতির পিতা।”

বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে এই বাম নেতা বলেন, “বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতিটি ইতিহাস হচ্ছে সংগ্রামের ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে তিনি ধাপে ধাপে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান। বাংলাদেশ পরবর্তীকালে একটি ধ্বংসস্তুপের দেশকে পুনর্গঠন করেছিলেন। দেশকে নিয়ে গিয়েছিলেন একটি অনন্য উচ্চতায়।”

ইতিহাস বিকৃতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “এরশাদ ও খালেদার আমলে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাসকে বিস্মৃতির ইতিহাসে তলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস ফিরিয়েই কেবল আনেননি, এখন আরও অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়েছে।”

৬ দফা নিয়ে বাম ঘরানার দলগুলোর অবস্থান ব্যাখ্যা করে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের নেতা রাশেদ খান মেনন বলেন, “এই সংসদে আমাদের বিরুদ্ধে অনেক সময় অভিযোগ করা হয়, বলা হয়, আমরা সেদিন ৬ দফার বিরোধিতা করেছিলাম। এ বিষয়ে আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, ৬ দফাকে মুক্তি সনদ মনে করা হয়। কি মতিয়া গ্রুপ, কি মেনন গ্রুপ- আমরা এটাকে মুক্তির সনদ মনে করি নাই। আমরা আরও কিছু দাবি অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছিলাম। আর সেই দাবিগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়ে ১১ দফায় রূপ নিয়েছিল। যার ফলে সেদিন অভ্যুত্থান ঘটেছিল। পূর্ববাংলার মুক্তির লড়াই সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। আমরা দেখলাম ৬ দফার চেহারা পাল্টে গেল। আমরা পূর্ববাংলা বলি বলে, আমার সোনার বাংলা লিখি বলে, যে ছাত্রলীগ একদিন আমাদের যুক্তবাংলার অনুসারী বলত সেই ছাত্রলীগ সেদিন সামনে এগিয়ে গেল। আমরা পিছিয়ে পড়লাম।

“’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু একক নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হলেন। বঙ্গবন্ধু তখন দলীয় নেতা ছিলেন না। ছিলেন দেশের নেতা। ছিলেন মানুষের নেতা। যে কারণে আমরা যারা তার বিপরীত অবস্থানে ছিলাম আমাদেরকেও সমানভাবে আদর করতেন। সকলের প্রতি তার সমান শ্রদ্ধাবোধ ছিল।”

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবতর্নের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “আমাদের দুর্ভাগ্য বাহাত্তরে ফিরে এলে আমরা বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দরে দেখতে যেতে পারিনি। কিন্তু পরের দিন গিয়েছিলাম তার বাসভবনে। দেখেই বললেন শোন, দেশ স্বাধীন করেছি। এবার সমাজতন্ত্র করব। আমরা বলেছিলাম, আপনি যদি সমাজতন্ত্র করেন আমরা আপনার সাথে আছি। এরপর দীর্ঘ ইতিহাস। আমাদের অবস্থান ছিল বিরোধী দলে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর কারও থেকে আমাদের কম ছিল না।”

বাকশাল গঠনের পর বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠিয়েছিলেন উল্লেখ করে মেনন বলেন, “আমরা গেলে বন্ধু ড. ফরাসউদ্দিন বললেন তোমাদের বাকশালে যেতে বলবেন। তোমরা রাজি হয়ে যেও। জবাবে বলেছিলাম, আমরা কি বলব সেটা আমরা জানি।

“আমাদের বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘সিরাতুল মুস্তাকিম বুঝিস? মানে সোজা পথ। শোন, সমাজতন্ত্র এবার করব। বিয়ের প্রথম রাতে বিড়াল মারতে হয়। প্রথম রাতে বিড়াল মারতে পারিনি। এবার বিড়াল মারতে হবে।’ আমরা সম্মানের সাথে বাকশালে যেতে অস্বীকার করলাম। বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, ওয়েট অ্যান্ড সি। আমরা দেখলাম তার সেই স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে গেল। তার ঘরের শত্রু বিভীষণরা খুনিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করল। সেই খুনিরা বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল আমরা তা জানি।”

এর আগে আলোচনায় অংশ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, “জিয়াউর রহমান-মোশতাক চক্র বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রক্ষাই শুধু করে নাই, তাদের বড় বড় চাকরিতে পদায়ন করে উৎসাহিত করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা নিছক কোনো ব্যক্তির হত্যা না। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যারা বিশ্বাস করে নাই তারা হত্যা করেছে।”

বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে যারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করতে কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, “সংসদ নেতা এখানে আছেন। বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত খুনিদের বের করতে হবে। ট্রুথ কমিশন করে এদের বের করতে হবে। জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় ওয়ার কাউন্সিল করে যুদ্ধ করতে চেয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার অস্বীকার করতে চেয়েছিল। শুধু ’৭৫ সালে নয় ’৭১ সালেও করেছিল।”

আলোচনায় আরও অংশ নেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, শামসুল হক টুকু, মির্জা আজম, আরমা দত্ত, হুইপ আতিউর রহমান আতিক, নারায়ন চন্দ্র চন্দ, জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম।