‘রক্তাক্ত ও কণ্টকাকীর্ণ পথ যাকে দমাতে পারেনি, তিনি শেখ হাসিনা’

এক বোন ছাড়া বাবা-মাসহ পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছিল ঘাতকরা- সেই শোক বুকে নিয়ে দেশের মাটিতে পা রেখে হন্তারকদের বিচারের প্রত্যয় জানিয়েছিলেন; যে বাঙালির মুক্তির জন্য বাবা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাদেরকে ‘হারানো স্বজনদের’ জায়গায় বসিয়ে এই জাতির উন্নয়নে নিজেকে সঁপেছিলেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 Sept 2020, 08:51 PM
Updated : 26 Sept 2020, 08:56 PM

এরপর এই চার দশকের পথচলায় জেল-জুলুমের সঙ্গে বার বার বন্দুক তাক করা হয়েছে তার দিকে, সন্ত্রাসীর বোমা-গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে- আর তিনি অবিরাম ছুটে চলেছেন লক্ষ্য অর্জনে; সংগ্রামী এই রাজনীতিক আর কেউ নন, বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শনিবার আওয়ামী লীগের আয়োজনে ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ানো আওয়ামী লীগ’ শীর্ষক বিশেষ ওয়েবিনারে যুক্ত হয়ে এভাবে নেত্রীর মূল্যায়ন করেছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী এবং শিক্ষামন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি।

তারা দুজনই আলোচনার সূত্রপাত করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রেক্ষাপট নিয়ে।

১৯৮১ সালে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা কীভাবে আওয়ামী লীগকে পুনর্গঠিত করে দেশের রাজনীতির পটপরিবর্তনের সূচনা করেন, আওয়ামী লীগকে কীভাবে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন- তার সংগ্রামের কথা শোনান আওয়ামী লীগের এই দুই জ্যেষ্ঠ নেতা।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা।

১৯৮০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা খবর পান, ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছে।

১৭ মে শেখ হাসিনা যেদিন দেশে ফেরেন, সেদিন প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে হাজার হাজার জনতা জড় হয়েছিল তেজগাঁওয়ের পুরনো বিমানবন্দরে।

ওয়েবিনারে আলোচনায় মতিয়া চৌধুরী।

বিমানবন্দর থেকে শেখ হাসিনাকে নিয়ে যাওয়া হয় মানিক মিয়া এভিনিউয়ে, সেখানে লাখো জনতার উপস্থিতিতে এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, “সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।

“আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সকলকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি। আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই।”

সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মতিয়া চৌধুরী বলেন, “কী অদ্ভূত উন্মাদনা ছিল! কত চাপা কষ্টই না ছিল তার বুকে। সেদিন এমন একজনকে আমরা বরণ করতে গিয়েছি, যিনি পৃথিবীতে সব কিছু হারিয়েছেন। বাবা নাই, মা নাই, ভাই নাই… কেউ নাই… দুঃখের পরিসীমা নাই। সেদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। আবহাওয়া ছিল অত্যন্ত বৈরী। সেদিনের বৈরী আবহাওয়াই বোধ হয় তার জীবনের সঙ্গে রূপক হয়ে ছিল।

“পঁচাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশকে যেভাবে দেখেছি, গণতন্ত্র বেয়নেট বুলেটে যেভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল, রক্তাক্ত হয়েছিল; সে দেশে বাস্তব অর্থে জীবন-মৃত্যুকে পায়ে ভৃত্য মনে করে এ দেশের নিপীড়ত মানুষকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি পা রেখেছিলেন।”

১৯৮১ সালের ১৭ মের ‘ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ’ দিনটির মতো শেখ হাসিনার পথচলা ‘ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ’ বলে মন্তব্য করেন মতিয়া চৌধুরী।

চট্টগ্রামের লালদিঘীর ময়দান, নাটোরের সমাবেশে শেখ হাসিনার উপর হামলাসহ তার প্রাণনাশের নানা চেষ্টার কথা তুলে ধরে মতিয়া চৌধুরী বলেন, “জেল-জুলুম, কারা-নির্যাতন, এসব শুধু তার পথ চলার পাথেয় নয়, বলতে গেলে প্রতিক্ষণের সঙ্গী। কিন্তু নিজের উপর আক্রমণের বিচার কিন্তু হয়নি। তার প্রতিজ্ঞা এত সুকঠিন ছিল যে তিনি তা থেকে এক চুলও নড়েননি।”

মতিয়া চৌধুরী বলেন, “শেখ হাসিনার সে প্রতিজ্ঞা ছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের মধ্যে তিনি যে শুধু পিতৃহত্যার বিচার করেছেন, তা নয়। তিনি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। যে আইনের শাসন বাংলার মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। সে বিচার করেছেন কোন আদালতে? সাধারণ মানুষ যে আদালতে গিয়ে পিতা হারানোর বিচার চায়, সেই আদালতেই। আজকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র এসেছে, এটা কার লড়াইয়ের বিনিময়ে বাংলার মানুষ জানে।

“একজন কন্যা তার অন্তহীন যাত্রা… ঝড়-জল-আঘাত-বুলেট-গুলি…রক্তাক্ত ও কণ্টকাকীর্ণ পথ যাকে কোনো অবস্থাতে দমাতে পারেনি।”

নবম জাতীয় সংসদে নির্বাচনে জিতে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করেই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।

ডিজিটাল বাংলাদেশের নানা সুফল যখন জনগণ পেতে শুরু করেছেন, তার কৃতিত্ব শেখ হাসিনাকে দিয়ে মতিয়া চৌধুরী বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে অভূতপূর্ব বিজ্ঞানমনস্কতা, তার সঙ্গে তিনি আমাদের সহযাত্রী করতে পেরেছেন। আজকে উন্নত যোগাযোগ প্রযুক্তির কারণে আমরা সারা পৃথিবীর সঙ্গে সহজে নিজেদের যুক্ত করতে পারছি।”

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতা যোগ দিয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদের মন্ত্রিসভায়। যারা যোগ দেননি, তাদের কেউ জেলে, কেউ পালিয়ে বেড়িয়েছেন।

শিক্ষামন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি।

সেদিনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে দীপু মনি বলেন, “আমরা শুনলাম, সেদিন হয়ত বা আওয়ামী লীগের ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্বল সময় ছিল। দলের অনেক প্রবীন নেতা মুশতাকের ক্যাবিনেটে গিয়েছিলেন, কেউ কেউ বাধ্য হয়ে গিয়েছিলেন, কেউ নিজেই হয়ত গিয়েছিলেন। যাদের প্রলুব্ধ করতে পারেননি জিয়াউর রহমান, যাদের ভয় দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি, তাদের অধিকাংশ জেলে কিংবা তারা সামনাসামনি নেই, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দেশ ও দলের মধ্যে ভঙ্গুর অবস্থা… সে অবস্থায় তিনি ফিরে এসেছিলেন।

“বঙ্গবন্ধুকন্যাকে নিজেদের মাঝে ফিরে পেয়ে বাঙালি আবার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিল, আবার সাহসে বুক বেঁধেছিল।”

১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত যেসব কাজ সম্পূর্ণ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন, তার প্রায় ‘পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে ফেলেছেন’ বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি।

তিনি বলেন, “দলের ভেতরে-বাইরে সব বৈরিতা মোকাবেলা করে তিনি যে পুরো পথটা হেঁটেছেন, সেদিন তিনি যে অঙ্গীকার করে করেছিলেন, তার পুরোপুরি বাস্তবায়ন করে ফেলেছেন।

“১৭ মের সংগ্রামের আরেকটা রূপ আমরা দেখি ২০০৭-০৮ সালে। তার প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি অসাধারণ। আমরা জানি, বঙ্গবন্ধু বলতেন, এটি হতে যাচ্ছে। আমরা পরে দেখেছি সত্যি এটা ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যার বেলায় বার বার আমরা তা দেখি।

“২০০৭-০৮ সালে বন্দি হওয়ার আগে তিনি যেমন বলেছেন, বাংলার মানুষ আন্দোলন করে, সংগ্রাম করে আমাকে অবশ্যই মুক্ত করবে, এ সরকার অবশ্যই নির্বাচন দিতে বাধ্য হবে এবং সে নির্বাচনে বাংলার জনগণ নৌকাকে জয়ী করবে।

“এই যে প্রত্যয়, আমার মনে হয় না এটি তার আশা ছিল, এটি ছিল তার স্বপ্ন, এটি তিনি বিশ্বাসও করতেন। আমার কাছে মনে হয়, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার গভীরতা থাকলে, সে ধরনের ইতিহাসবোধ থাকলে, মানুষের সাথে সম্পৃক্ততা থাকলে ভবিষ্যৎ দেখবার দৃষ্টি মানুষের তৈরি হয়।”

কলামনিস্ট সুভাষ সিংহ রায়ের সঞ্চালনায় এ আলোচনায় যোগ দেন বাসসের পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, মুক্তিযোদ্ধা ও সিনিয়র সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত, শহীদ বুদ্ধিজীবীকন্যা নুজহাত চৌধুরী।