বিশ্ব পরিস্থিতি একাত্তর, পঁচাত্তরের মতো নয়: ফখরুল

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ১৯৭৫ সালে জাতির জনকের হত্যাকাণ্ড- বাঙালির ইতিহাসের বাঁক বদলের এই দুই সময়ের বিশ্ব পরিস্থিতি এখন নেই, সে কথা স্মরণ করিয়ে বর্তমানের উপযোগী কৌশল নিয়ে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের’ আন্দোলনের কথা বললেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Sept 2020, 04:42 PM
Updated : 1 Sept 2020, 04:42 PM

বিএনপির ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে মঙ্গলবার এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় একথা বলেন তিনি।

দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবন্দিত্বকে ‘গণতন্ত্রের জন্য তার ত্যাগ’ হিসেবে চিত্রায়িত করেন মির্জা ফখরুল।

তিনি বলেন, “গণতন্ত্রের জন্যই দেশনেত্রী আজকে গৃহবন্দি অবস্থায়, কারাবন্দি হয়ে আছেন। তার যে ত্যাগ গণতন্ত্রের জন্য, বাংলাদেশের মানু্ষের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য- এটা নিঃসন্দেহে অপরিসীম একটা ত্যাগ।

“আজকে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমাদের বড় প্রতিজ্ঞা হোক- যে কোনো মূল্যে আমাদের চ্যালেঞ্জ গণতন্ত্রকে উদ্ধার করা, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা। দেশনেত্রীকে মুক্ত না করলে গণতন্ত্র মুক্ত হবে না- এটা হচ্ছে জরুরি কথা এবং সেটা আমাদেরকে অবশ্যই অত্যন্ত যথাযথ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সফল করতে হবে।”

গত অর্ধ যুগ ধরে আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপির মহাসচিব সেই যথাযথ আন্দোলন কী, তা না বলেননি। তবে বিশ্ব পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ার কথা বলেছেন তিনি।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারদের থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ মুক্তিকামী বাঙালির পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। অপরদিকে আমেরিকা, চীন ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশের সমর্থন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে।

স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের যাত্রাপথে এক বিরাট পরিবর্তন হয়। ইতিহাসের জঘন্যতম ওই হত্যাকাণ্ডের পর বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান।

জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীতে থাকা অবস্থায় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা রেস্তোরাঁয় এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।

এখনকার বিশ্ব পরিস্থিতি ওই দুই অবস্থার মতো নেই জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, “আজ বিশ্ব রাজনীতি পরিবর্তিত হচ্ছে। ১৯৭১ সালে যে পরিস্থিতি ছিল, এখনকার পরিস্থিতি এক নয়; ১৯৭৫ সালে যে পরিস্থিতি ছিল, এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। আজকে ২০২০ সালে যে বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট, সেই বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটকে অনুধাবন করে এবং যোগ্য কৌশল উদ্ভাবন করে আমাদেরকে সেই কৌশলের সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য গণতান্ত্রিকভাবেই এগিয়ে যেতে হবে।”

তবে লক্ষ্য অর্জনের জন্য আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন বিএনপি মহাসচিব ফখরুল।

“কিন্তু সেই আন্দোলন কীভাবে ফলপ্রসূ হবে সেই বিষয়টা আমাদেরকে দেখতে হবে, বুঝতে হবে এবং তার জন্য আমাদেরকে আলোচনা করতে হবে, আলোচনার মধ্য দিয়ে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।”

এজন্য দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলোকে সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

সরকার নতুন প্রজন্মকে ‘বিভ্রান্ত করতে’ জিয়াউর রহমান ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ‘অপপ্রচারের কৌশল’ নিয়েছে বলে অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল। এর বিরুদ্ধে ছাত্র সংগঠনকে ‘ভ্যানগার্ডের’ ভূমিকা পালন করার আহ্বান জানান তিনি।

সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ফখরুল বলেন, “আসুন হতাশ হবেন না, অনেকে হতাশার কথা বলেন। হতাশ হওয়ার সুযোগ নেই। এটা বিএনপির উপর দায়িত্ব। গোটা জাতি এটা বিএনপির উপর দিয়েছে।

“আজকে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপর গোটা জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। তিনি বিএনপিকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন, এই জাতিকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে হবে। গণতান্ত্রিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ- যার স্বপ্ন শহীদ জিয়াউর রহমান দেখেছিলেন, যার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন এবং যার পতাকা দেশনেত্রী উড্ডীন করেছেন. সেটা সফল করতে হবে।”

আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বক্তব্য রাখেন।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সকালে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে শেরেবাংলা নগরে  জিয়াউর রহমানের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “এই অবস্থা থেকে পরিবর্তন আসবে। সেই পরিবর্তন করার দায়িত্বটা বিএনপির। কেননা আওয়ামী লীগ গণতন্ত্র হত্যা করেছে, তারা তো গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেবে না, মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেবে না। সেজন্য বিএনপিকে সেই গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার গুরু দায়িত্ব নিতে হবে। দেশের সকল জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে ইস্পাত কঠিন গণঐক্য করে এই সরকারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে।”
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, “আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া একটা অহেতুক বানোয়াট মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। দুই বছর তাকে কারাগারে রেখেছিল। এখন তার সাজা স্থগিত রেখে তাকে বাড়িতে রেখেছেন। কিন্তু অন্তরীণ থাকার মতোই। তিনি সম্পূর্ণভাবে মুক্ত নন।

“আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে তাকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করা। এটা আমাদের একটা অন্যতম কর্তব্য হবে বা লক্ষ্য হবে বেগম খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে আমাদের মাঝখানে নিয়ে আসা।”

লন্ডন থেকে তারেক রহমান বিএনপির নেতৃত্ব দেওয়ায় তার ভূয়সী প্রশংসাও করেন মওদুদ।

বিএনপিকে ‘ভয় পায়’ বলে সরকার প্রধানসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বিএনপি, জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যাচার’ করে নতুন প্রজন্মকে ‘বিভ্রান্ত করছে’ বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই মন্তব্য করে স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, “কতৃত্ববাদী সরকারের পতন হবে। তবে এই পতন নিজের থেকে হবে না। অন্য কেউ এসে করে দেবে না। এই পরিবর্তন আমাদেরকেই করতে হবে, দেশে গণতন্ত্র আমাদেরকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

“শহীদ জিয়াউর রহমানের গণতন্ত্র, বেগম খালেদা জিয়ার সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য, আইনের শাসন ফিরিয়ে আনার জন্য, দেশে একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং আন্দোলন করতে হবে। আমাদেরকে প্রয়োজনে আরো ধৈর্য ধরতে হবে কিন্তু আন্দোলন ছাড়াই এই কতৃত্ববাদী সরকারের পতনের কোনো বিকল্প আছে বলে আমি মনে করি না।”

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, “বিভিন্ন দেশে দেখা যায়, বিলুপ্তি ঘটে। এখানে কী হয়েছে? এখানে দেখা যায় বিলুপ্তি ঘটে না, এই ফ্যাসিবাদী সরকারের বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। কোনো কতৃত্ববাদী সরকার, কোনো ফ্যাসিবাদী সরকার কখনোই বিনা চ্যালেঞ্জে বিনা আন্দোলনে যায় না, আওয়ামী লীগও যাবে না।

“কতৃত্ববাদী ফ্যাসিবাদী সরকার- এদেরকে তাড়াতে হবে। এদের তাড়ানোর জন্য এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমাদের শপথ হোক- আমরা যে কোনো মূল্যে আমাদের নেতার নির্দেশে আমরা এমন কিছু করব, যেমনি আমরা নব্বইয়ে এবং পরবর্তী সময়ে আন্দোলনে আমরা ফ্যাসিবাদী সরকারকে তাড়িয়েছিলাম, এই সরকারকেও ইনশাল্লাহ আমরা তাড়াব। আজকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।”

১৯৭২-৭৪ সালে ‘মুক্তিযোদ্ধা ও ভিন্ন চিন্তার মানুষ হত্যার’ ইতিহাস তুলে ধরে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, “ওই সময়ে তারা (আওয়ামী লীগ) মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা শুরু করে, যার তালিকা ৩০ হাজারের উপরে। সেই দল দাবি করে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দল।

“তারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করেছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে বা ’৭০ সালের নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন তার মধ্যে ৪৩ জন আছেন যারা পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন, যারা স্বাধীনতার যুদ্ধের বিপক্ষে বিবৃতি দিয়েছিলেন তারা কিন্তু ঘুরে-ফিরে আবারও এই সংসদে আসছেন। তাদেরকে তিরস্কারও হয়নি, তাদের বিচারও করা হয়নি, তাদের আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারও করা হয়নি। তারা মুক্তিযুদ্ধের দল!”

তিনি বলেন, “শহীদ জিয়াউর রহমান খাল খনন করছিলেন কেন? শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব। কী কারণে পানির অভাব? ফারাক্কার মধ্য দিয়ে এই যে পানি প্রবাহ আটকানো। তিনি ভেবেছিলেন যে, ফারাক্বায় ভারতের সাথে চুক্তি করে পানি এনে পারবেন না। তাই তিনি স্বনির্ভর করার জন্য পানির ক্ষেত্রে খাল-বিল-নদী-নালা খননের কাজ শুরু করেন। তখন সংসদে আওয়ামী লীগের এক নেতা রসিকতা করে বলেছিল, জিয়াউর রহমান খাল কেটে কুমির আনছেন।

“সেদিন তার কথাটা কেউ পছন্দ না করলেও আজকে দেখা যায়, জিয়াউর রহমান খাল কেটে পানি আনার সাথে যে একটা কুমির আসছিল। অনেক কাল পরে জনগণ লক্ষ করছে, যে কুমিরের পেটে আজকে গণতন্ত্র, যে কুমিরের পেটে আজকে বিচার বিভাগ, যে কুমির বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করে, যে কুমির খুন করে, গুম করে, যে কুমিরের কারণে দেশনেত্রীকে বিনা বিচারে জেলে থাকতে হয়।”     

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির সঞ্চালনায় ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য জমিরউদ্দিন সরকার, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, মহানগর দক্ষিণের হাবিব উন নবী খান সোহেল, উত্তরের মুন্সি বজলুল বাসিত আনজু, যুব দলের সাইফুল আলম নিরব, শ্রমিক দলের আনোয়ার হোসেইন, মহিলা দলের আফরোজা আব্বাস, মুক্তিযোদ্ধা দলের ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, স্বেচ্ছাসেবক দলের আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল, ছাত্র দলের ফজলুর রহমান খে্াকন, মৎস্যজীবী দলের আবদুর রহিম বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কাজী আবুল বাশার, আবদুল আলীম নকি, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, হাসান জাফির তুহিন, সুলতানা আহমেদ, নজরুল ইসলাম তালুকদার, ইকবাল হোসেন শ্যামলও যুক্ত ছিলেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে উলামা দলের শাহ নেছারুল হক দলের প্রতিষ্ঠাতাসহ নেতা-কর্মীদের জন্য মোনাজাত পরিচালনা করেন।