‘হতাশার’ মধ্যেই ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দুয়ারে বিএনপি

এক দশকের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থেকে ‘মামলা-মোকদ্দমায় জর্জরিত’ নেতাকর্মীদের হতাশা আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই ৪২ বছর পূর্ণ করছে বাংলাদেশের বড় দুই রাজনৈতিক দলের একটি বিএনপি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 August 2020, 05:09 PM
Updated : 30 August 2020, 05:39 PM

করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হবে সীমিত পরিসরে। সকালে দলের কেন্দ্রীয় ও জেলা কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন, শেরেবাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ভার্চুয়াল আলোচনা সভা থাকছে তাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচিতে।

এ উপলক্ষে সারাদেশে দলের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

মির্জা ফখরুল বলেন, “বিএনপি সৃষ্টির ভিত্তি হচ্ছে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এখন বিএনপি সংগ্রাম করছে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে, মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনার জন্যে।”

বিএনপির যাত্রাপথ

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হন।

৭ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানের পর তিনি শাসন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন; ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর তিনি হন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক।

১৯৭৭ এর ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাদাত সায়েমকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে যেতে হয়, জিয়া তখন ওই দায়িত্বও নেন। সে সময় জিয়ার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টায় একটি গণভোটের আয়োজন করা হয়, যাতে ৯৮.৯ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়ে।

সামরিক আইন প্রশাসক থাকা অবস্থায় জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে একটি ডানপন্থি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠিত হয়। তবে সে দল তখন দেশের রাজনীতিতে নাড়া দিতে পারেনি।

ওই বছর ১ মে জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে আনুষ্ঠানিকভাবে 'জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট' ঘোষণা করা হয়। সেনাবাহিনী প্রধানের পদে থেকে পুরাদস্তুর রাজনীতিবিদ বনে যান জিয়া। ৩ জুন নির্বাচন দিয়ে ওই 'জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট' থেকে প্রার্থী হয়ে তিনি ‘নির্বাচিত’ রাষ্ট্রপতি হন।

নির্বাচনের তিন মাসের মাথায় ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা রেস্তোরাঁয় এক সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন।

জাগদল, মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বাধীন ন্যাপ, আবদুল হালিম-আকবর হোসেনের নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড পিপলস পার্টি, আব্দুল মতিনের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি ও শাহ আজিজুর রহমানের মুসলিম লীগ বিলীন হয় জিয়ার বিএনপিতে।

১৯৮১ সালের ৩০ মে এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত জিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন। ২০১০ সালে সপ্তম সংশোধনী বাতিলের রায়ে জিয়ার ক্ষমতাগ্রহণকে অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালত।

জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার এক বছরের মধ্যে রাজনীতিতে নেমেই দলের ভাইস চেয়ারম্যান পদ নেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। তখন বিএনপির চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার।

সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ ১৯৮২ সালে বিএনপি হটিয়ে ক্ষমতা দখল করলে সাত্তারের অসুস্থতার মধ্যে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের পদ নিয়ে দলের হাল ধরেন খালেদা। তারপর ১৯৮৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন খালেদা।

সেই থেকে খালেদা এই পদে রয়েছেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার পর দুই বার তার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে বিএনপি।

নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের পর পাঁচ বছর সংসদের বাইরে থাকতে হয় বিএনপিকে। কয়েক দফা সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেও সফল হননি খালেদা, বরং ২০১৫ সালে তিন মাসের হরতাল-অবরোধের মধ্যে জ্বালাও-পোড়াওয়ের জন্য তাকেই দায়ী করে আসছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে দুর্নীতি মামলার সাজায় কারাগারে যেতে হলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান ছেলে তারেক রহমান, যিনি গত এক যুগ ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে দেশে তিনটি মামলায় তার সাজার রায় এসেছে।

খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখেই ২০১৯ সালের নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। তাতে চরম ভরাডুবির পর সরকারের বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তোলেন বিএনপি নেতারা।

গত ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি পাওয়ার পর থেকে নিজের বাসাতেই আছেন খালেদা জিয়া। ইতোমধ্যে তার দণ্ড স্থগিতের মেয়াদ বাড়াতে সরকারের কাছে আবেদন করেছে তার পরিবার।

৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সামনে রেখে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, “জনগণের নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানোর পরেও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ বিএনপি এই সংগ্রামকে বিজয়ী করবার জন্যে কাজ করে চলেছে। এখনকার বিএনপি অন্য সময়ের তুলনায় বেশি শক্তিশালী।”

এই দীর্ঘ পথে বিএনপিকে অনেক বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বিভিন্ন সময়ে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার ষড়যন্ত্র হয়েছে, এখনো হচ্ছে। যতই নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হোক না কেন, বিএনপি ফিনিক্স পাখির মতই জেগে উঠবে।

“বাংলাদেশেন মানুষের ভালোবাসা, দেশপ্রেম, স্বাধীন থাকবার যে আগ্রহ-আকাঙ্ক্ষা, তাকে কোনোদিন দাবিয়ে রাখা যাবে না।”

বিএনপির ‘কঠিন সময়’

বিএনপি ভাষ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গত ১১ বছরে ‘এক লাখের বেশি রাজনৈতিক মামলা’ রয়েছে তাদের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে, সেখানে আসামির সংখ্যা ৩৫ লাখের বেশি।

দলটির নেতাদের অভিযোগ, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে প্রায় তিন হাজার মানুষ ‘বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের’ শিকার হয়েছেন এবং তাদের অধিকাংশই ‘বিরোধী দলের নেতা-কর্মী’।

মামলা-মোকাদ্দমায় জর্জরিত নেতা-কর্মীদের ভাষায়, খুবই ‘কঠিন সময়’  পার করতে হচ্ছে তাদের। মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের কথায় সেই হতাশার সুর স্পষ্ট।

নীলফামারীর ডিমলার যুবদল কর্মী সাহেব আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার বিরুদ্ধে ৬৭টি মামলা। গত ৪/৫ মাস করোনার মধ্যেই ভালো ছিলাম। এখন আবার হাজিরা দিতে পুরো সাপ্তাহ আদালতের বারান্দায় সময় কাটাতে হচ্ছে। আর পারছি না।

“আর কতদিন এভাবে চলতে হবে আমাদের? নেতাদের কাছে এই প্রশ্ন করও তারাও কোনো জবাব দিতে পারেন না।”

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার বাসিন্দা মোজাফফর আহমেদ বিএনপির মাঠ পর্যায়ের কর্মী। তিনি বলেন, “কোনো আশা দেখি না ভাই। এত মামলার বোঝা আর সইতে পারছি না।”

দুর্নীতির দায়ে ২৫ মাস সাজা ভোগের পর গত ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

খালেদার অসুস্থতায় নেতা-কর্মীরা দুশ্চিন্তায়

সরকারের নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া আপাতত কারাগারের বাইরে থাকলেও তার অসুস্থতা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে তারা নেত্রীর সাক্ষাৎও পাচ্ছেন না। স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও যোগ দিচ্ছেন না বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

কুমিল্লার বুড়িচং থানা বিএনপির কর্মী ৭৫ বছর বয়েসী আকবর আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশনেত্রীর দীর্ঘ অসুস্থতা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। ম্যাডাম কি আর রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারবেন?

“যে যাই বলুক, বিএনপির প্রাণ বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপিকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া এবং জনপ্রিয় দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্ব ম্যাডামের। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন ম্যাডামকে দীর্ঘজীবন দেন, সুস্থ করে দেন।”

দল পুনর্গঠন

বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল হয়েছিল ২০১৬ সালের মার্চে। গঠনতন্ত্রের তিন বছর পর কাউন্সিল হওয়ার কথা থাকলেও সেই সময় পার হয়ে গেছে।

সারা দেশে বিএনপির ৮০টি সাংগঠনিক কমিটি মধ্যে মাত্র ৩৪টি পূর্ণাঙ্গ কমিটি, ২৩টি আহ্বায়ক কমিটি এবং ১৬টি আংশিক কমিটি রয়েছে। বাকি জেলাতে অনেক বছর আগে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া কমিটিই দায়িত্ব রয়েছে। যেমন, নরসিংদী জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৩ সালে, পটুয়াখালী জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৫ সালে।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগী বলেন, “কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিস্ট সরকার বিএনপিকে সাংগঠনিক কার্যক্রম করতে দেয় না, কোথাও ঘরোয়া সভা করতে গেলে পুলিশ হানা দেয়।”

জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শফিউল বারী বাবুর আকস্মিক মৃত্যুতে সংগঠনের কমিটি গঠনের কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। তাছাড়া মহামারীর কারণে দলের সাংগঠনিকত কার্যক্রমও ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ।

১৫ সেপ্টেম্বরের পর সেই কাজ আবার শুরু হবে জানিয়ে ফখরুল বলেন, “বিএনপি এখন অনেক গতিশীল হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেবের নেতৃত্বে সংগঠনকে ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে।”