সামরিক শাসকদের দল করা কেউ যেন আওয়ামী লীগে না ভেড়ে: শেখ হাসিনা

সামরিক শাসকদের গড়া রাজনৈতিক দল যারা করেছে, কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে যারা ছিল, তারা যেন কোনোদিন মুক্তিযুদ্ধের দল আওয়ামী লীগে যোগ দিতে না পারে, সেজন্য নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে ‘আদর্শ নিয়ে’ রাজনীতি করার আহ্বান জানিয়েছেন দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 August 2020, 08:05 AM
Updated : 30 August 2020, 05:42 PM

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রোববার আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখা আয়োজিত আলোচনা সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে তিনি এই কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে এদিক ওদিক থেকে কিছু লোক জোটে এবং দলের ভেতরে এসে তারা নানা রকম অঘটন ঘটায়, অপকর্ম করে, যার বোঝাটা দলকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয়।

“যে কারণে আমি বারবার শুরু থেকে আমাদের নেতাকর্মীদের হুঁশিয়ার করেছিলাম যে এই ধরনের যারা… বিশেষ করে মিলিটারি ডিক্টেটরদের হাতে তৈরি করা যে সমস্ত রাজনৈতিক দল, সেগুলো যারা করে এসেছে বা যুদ্ধাপরাধীদের সাথে যারা ছিল, আমাদের দলে যেন তারা না আসে। এলে দলেরই ক্ষতি করে।”

‘তারাই বিভিন্ন সময়ে অঘটন ঘটায়’ মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, “আমাদের ভালো ভালো নেতাকর্মীদের তারাই হত্যা করে। বাইরে আসে কি… দলের কোন্দল। কিন্তু খুঁজলে দেখা যায় যে এরা হয় এখান থেকে সেখান থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, বা তখন খুব ভালো ব্যবহার করে এমনভাবে চলে এসেছে যে আমাদের কেউ কেউ দল ভারি করার জন্য তাদেরকে কাছে টেনে নিয়েছে। কিন্তু এটা নেওয়া আমাদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকের।”

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের ‘একমাত্র’ আওয়ামী লীগই তৃণমূল পর্যন্ত সুসংগঠিত দল। সেভাবেই আদর্শের ভিত্তিতে সংগঠনকে গড়ে তুলতে হবে।   

শোষিত বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন সংগ্রামের কথা আলোচনা সভায় তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

১৯৭৫ সালে তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, “জাতির পিতা কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিলেও কেউ কেউ জাতির জনকের সমালোচনায় মুখর ছিল। এত কিছুর পরও কিছু লোক তো… কোনো কিছুই নাকি হয়নি! কোনো উন্নয়নই নাকি হয়নি! কোনো কিছুই নাকি করেনি! সেই কথা বলা, লেখা এবং বিভ্রান্তি ছড়াতে শুরু করে। কেন? কোন উদ্দেশ্যে? কি কারণে? তার ফলাফল কী হয়েছিল?

তিনি বলেন, “অনেকে গণতন্ত্রের কথা তোলে। মার্শাল ল অর্ডিন্যান্স দিয়ে যখন সংবিধান স্থগিত করে দিয়ে, সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা কেউ দখল করে, তারা গণতন্ত্র দেয় কীভাবে? মার্শাল ল দিয়ে তো কখনো গণতন্ত্র হয় না। আইয়ুব খান যা করেছে, ইয়াহিয়া খান যা করেছে, জিয়াউর রহমানও তাই করেছে, এরশাদও তাই করেছে। গণতন্ত্র মুখে ছিল, কিন্তু বাস্তবে কী ছিল?”

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রোববার আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখা আয়োজিত আলোচনা সভায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: পিএমও

১৯৭৫ সালের পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ‘অগণিত নেতাকর্মীদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে’ বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

“সেই সাথে ওই সময় সেনাবাহিনীতে একটার পর একটা ক্যু হয়েছে, সেনাবাহিনীর হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে, জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দিনে ৮টা/১০টা করে ফাঁসি হত যাদের চিৎকারে কারাগারের আকাশ বাতাস ভারী হত।”

শেখ হাসিনা বলেন, “জিয়াউর রহমান সারা দেশে একটা খুনের রাজত্ব কায়েম করেছিল। পাশাপাশি জাতির পিতার খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরষ্কৃত করেছিল। এখানে গণতন্ত্রটা কোথায়? মার্শাল ল দিয়ে যারা ক্ষমতায় আসে, তারা গণতন্ত্র দিতে পারে না।”

যারা ‘গণতন্ত্র নেই’ বলে সরকারের সমালোচনা করছে, তাদের দিকে ইংগিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের যারা বুদ্ধিজীবী, জ্ঞানীগুণী, অনেকেই গণতন্ত্র খুঁজে বেড়ান। কিন্তু… সেই ইমার্জেন্সি যখন জারি হয়, তখন অথবা এই রকম মিলিটারি ডিক্টেটর এলে, তখন তারা গণতন্ত্র পান, স্বাদ পান। কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিবেশে তারা গণতন্ত্র পান না।”

“অর্থাৎ তাদের চরিত্রটা হচ্ছে চাটুকারিতা করা, তোষামোদি করা। কারণ যারা এভাবে হঠাৎ করে ক্ষমতা দখল করে, তারা এই তোষামোদকারীদেরকে হায়ার করে। তারা সব সময় এইভাবে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য তৈরি থাকে। কিন্তু সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ধারা যখন থাকে, তখন এদের মূল্য থাকে না। কারণ যতই বুকে লিখে রাখুক ‘ইউজ মি’... গণতান্ত্রিক সরকার তাদের ব্যবহার করবে না। তাই তাদের চিৎকার ‘গণতন্ত্র নাই, এটা নাই, সেটা নাই’।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, একমাত্র গণতান্ত্রিক সরকার থাকলেই দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা, জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করা, তাদের খাবার জোগাড় করা, তাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা, তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব।

সরকার যে জনগণের কল্যাণে কাজ করে, ১৯৭৫ সালের ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জনগণ তা আবার উপলব্ধি করেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট আমরা যারা আপনজন হারিয়েছি, আমরা আমাদের সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব, রিক্ত হয়েছি, আমরা এতিম হয়েছি। আমরা ব্যক্তিগতভাবে সব হারিয়েছি, কিন্তু রাষ্ট্র হারিয়েছে একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের সকল সম্ভাবনাকে।”

জাতির জনকের স্ত্রী ও নিজের মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যিনি চিরদিন আমার বাবার পাশে থেকে… বাঙালি জাতির সকল উন্নয়নে, সংগ্রামে এবং অর্জনে যার ভূমিকা অনবদ্য… বিশেষ করে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে তার ত্যাগ তিতিক্ষা সব সময় স্মরণীয়; ঘাতকের নির্মম বুলেট তাকেও আমাদের মাঝ থেকে কেড়ে নিয়ে গেছে।”

সেদিন হত্যাকারীরা বঙ্গবন্ধুর ছোট ছেলে শিশু রাসেলকেও যে রেহাই দেয়নি, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “তার জীবনের স্বপ্ন ছিল, বড় হলে সে একজন সেনা অফিসার হবে। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতেই তাকে জীবন দিতে হয়েছিল।”

জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে রোববার আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখা আয়োজিত আলোচনা সভায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: পিএমও

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কর্নেল রশীদ, কর্নেল ফারুক, মেজর নূর, মেজর হুদা, শাহরিয়ার, মোসলেহউদ্দিন, পাশা, খায়রুজ্জামানসহ এই রকম আরও অফিসার… তারা এত বড় সাহসটা পেয়েছিল কার কাছ থেকে? তাদের নিজের কথায়... বিবিসিতে দেওয়া কর্নেল রশীদ এবং কর্নেল ফারুকের ইন্টারভিউ এবং বিদেশি বিভিন্ন পত্রিকায় তারা যে ইন্টারভিউ দিয়েছিল, সেখানে তারা নিজেরাই স্বীকার করেছিল যে তাদের সাথে জিয়াউর রহমান আছে। জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে তারা সব ধরনের সহযোগিতা পেয়েছিল। আর সেই সাথে বেঈমানি, মুনাফেকি করেছিল মোশতাক, যিনি আমার বাবার কেবিনেটেরই আরেকজন মন্ত্রী ছিলেন। সেও এই ঘটনার সঙ্গে সম্পূর্ণ জড়িত।

“১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের পর মোশতাক নিজেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। মোশতাকের সব থেকে বিশ্বস্ত ছিল জিয়াউর রহমান। জেনারেল শফিউল্লাহ, যিনি সেনাপ্রধান, তাকে সরিয়ে দিয়ে মোশতাক সেনাপ্রধান বানায় জিয়াউর রহমানকে।”

শেখ হাসিনা বলেন, “এই হত্যার মধ্য দিয়ে খুনিরা ক পেয়েছে? আশুরার দিনে নবী করিম (সা.) এর নাতি ইমাম হোসেনকে কারবালা ময়দানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল, কারণ তারা ন্যায়ের পথে ছিল। কিন্তু কারবালার ওই হত্যাকাণ্ডে নারী বা শিশুদের কিন্তু হত্যা করা হয়নি।

“কিন্তু ১৫ অগাস্ট ধানমণ্ডির বাড়িতে নারী ও শিশু, মিন্টো রোডে নারী ও শিশুরা রক্ষা পায়নি। তারপরও ১৫ অগাস্টের ঘটনার সাথে যেন এই কারবালার ঘটনার এক অদ্ভুত মিল রয়ে গেছে। এই ঘটনা সব সময় সেই কারবালার ঘটনাকেই স্মরণ করিয়ে দেয় যে আরেকটি কারবালার ঘটনা ঘটে গেল বাংলাদেশে।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “জাতির পিতার অপরাধটা কী ছিল? একটি দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, একটি জাতিকে আত্মপরিচয়ের সুযোগ করে দিয়েছেন, মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন, তাদের উন্নত জীবন দিতে চেয়েছিলেন। এটাই কি তার অপরাধ ছিল?

জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর তার নাম মুছে ফেলার চেষ্টায় যে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল, সে কথাও বলেন তিনি।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে বাঙালির ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার সংগ্রামের বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব দেওয়ার কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন তার মেয়ে শেখ হাসিনা।  

তিনি বলেন, “আমি আমার নিজের জীবনটা উৎসর্গ করেছি দেশের মানুষের কল্যাণে। একটাই লক্ষ্য যে বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলব।”

কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে মানুষের পাশে থেকে সাহায্য করায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ধন্যবাদ জানান সরকার প্রধান।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই আলোচনা সভায় দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, আফম বাহাউদ্দিন নাছিম, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়াসহ দলের কেন্দ্রীয়, মহানগরের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।  

আর গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, প্রেস সচিব ইহসানুল করিমসহ ঊর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।