পিপিপিতে পাটকল পরিচালনা আসলে লুটপাটের আয়োজন: সেলিম

সরকারি-বেসরকারি (পিপিপি) অংশীদারিত্বে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব পাটকলগুলো পরিচালনার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা প্রকৃতপক্ষে পুঁজিপতিদের ‘লুটপাটের আয়োজন’ বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 August 2020, 04:19 PM
Updated : 29 August 2020, 04:19 PM

পাট, পাটশিল্প ও পাটচাষী রক্ষায় বাম গণতান্ত্রিক জোটের আয়োজনে জাতীয় কনভেনশনে তিনি এই মন্তব্য করেন। শনিবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রাজধানীর পল্টনে মুক্তি ভবনের মৈত্রী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় এই কনভেনশন।

চলতি বছর জুলাই মাসের শুরুতে শ্রমিকদের ‘শতভাগ’ পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকলের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে সরকার। ২৬টি পাটকলের ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী কর্মচারীর চাকরি গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসায়নের সিদ্ধান্তও আসে তখন।

বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী জানিয়েছেন, সরকারি কোনো পাটকল বিক্রি করা হবে না। প্রথমে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) চালানোর চেষ্টা করা হবে।

এই পিপিপি প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করে বামপন্থি রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, সরকারি সম্পত্তি ব্যক্তি মালিকানাধীন হলে দুর্বৃত্তায়নের সুযোগ বাড়বে।

সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম জাতীয় কনভেনশনে বলেন, “কারখানা বন্ধ করে আবার ব্যক্তি মালিকানায় কারখানা চালু হবে তা কিন্তু না। আদমজীর ক্ষেত্রে আমরা যা দেখেছি। এটা (পিপিপি) লুটপাটের একটা আয়োজন। সেটা করার জন্য তারা (সরকার) ফন্দিফিকির করেছে। করোনাকালে এটা মানবতাবিরোধী পদক্ষেপ।

“আমাদের সংবিধানের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, উৎপাদন যন্ত্র, ব্যবস্থা, বণ্টন প্রণালীসমূহের মালিকানা হবে রাষ্ট্রীয় মালিকানা। অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান প্রধান ক্ষেত্র লইয়া গতিশীল রাষ্ট্রীয় খাত সৃষ্টি করতে হবে। সেদিক থেকে দেখলে এটা (পিপিপি) কিন্তু সংবিধানবিরোধী পদক্ষেপও।”

রাষ্ট্রায়ত্ত্ব পাটকলগুলোর লোকসানের পেছনে সরকার যেসব কারণ উত্থাপন করেছে, তাতে একমত হতে পারছেন না সিপিবি সভাপতি।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “অফ সিজনে লো কোয়ালিটির পাট কিনে টাকা মেরে দেয়….. একটা মাথাভারী প্রশাসন… এসব কারণেই লোকসান হচ্ছে। দুর্নীতি, ভুলনীতি ও লুটপাট- এ তিনটা জিনিস হল এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এইগুলো বন্ধ করেন, পাটশিল্প লাভজনক হয়ে যাবে।”

তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব আনু মুহাম্মদও পিপিপির সমালোচনা করে বলেন, “পাটকলগুলো বেসরকারি খাতে দেবে…কিন্তু বেসরকারি খাতে নিশ্চয়তা নাই। বেসরকারি খাতে যারা নিচ্ছেন তাদের লক্ষ্য একটাই, পাটকলগুলোর বহু হাজার টাকার জমি দখল, সম্পদ দখল।

“বিভিন্ন শিল্পের জমি বিতরণ কর্মসূচির জন্য মসিউর রহমানের নেতৃত্বে একটা কমিটি হয়েছে অনেক আগেই। তাদের ধারাবাহিকতায় আজকের এ পলিসি।”

অর্থনীতির অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “ আমাদের শিল্পায়নের দরকার ছিল, কর্মসংস্থান দরকার ছিল। পাট শিল্প পরিবেশবান্ধব শিল্প। পাট শিল্প বিকশিত হলে বাংলাদেশে নতুন শিল্পায়নের যাত্রা হত, কৃষিও তো শক্তিশালী জায়গায় যেতে পারত। বিরাট ভবিষ্যৎ হতে পারত। সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব পাটকলগুলো শেষ করে দিল।”

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “এখন তারা (বেসরকারি মিল মালিকরা) পিপিপির কথা বলছে না। তারা বলছে, লিজ নেবে। লিজ কিভাবে নেবে?  ইতোমধ্যে শিল্পপতিরা শিল্পাঞ্চল পরিদর্শন করার পরে রিপোর্ট দিয়েছেন, ‘আমরা পিপিতে যাব না, আমরা লিজ চাই, ৯৯ বছরের লিজ চাই।

“এখন কথা হল, টাকা কোথা থেকে আসবে? সরকারকে আবার ব্যাংক থেকে টাকা দিতে হবে। খেয়াল করেন, চুরির পরে আরও চুরি, বাটপারির উপরে আরও বাটপারি, এটাকে তারা দখল নেবেন। মানুষের হক, ব্যাংকের টাকা, আবার লুটপাট… পাটকল চালানোর নামের লুটপাটের উৎসবে পরিণত করবে।”

কনভেনশনে সভাপতিত্ব করেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বাসদ নেতা বজলুর রশীদ ফিরোজ। পরে বক্তব্য রাখেন বাসদ (মার্কসবাদী)-র সাধারণ সম্পাদক মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক।

কনভেনশনে খুলনা, যশোর, সিরাজগঞ্জ, ডেমরা, নরসিংদী, চট্টগ্রামের পাটকল শ্রমিক নেতাসহ নানা শ্রেণি-পেশার এবং বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতারা মিলনায়তনে উপস্থিত থেকে ও ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখেন।

সন্ধ্যায় কনভেনশন শেষে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ তাদের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

কর্মসূচিগুলো হল- ১ সেপ্টেম্বর প্রত্যেক পাটকলের গেইটে মিটিং ও সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ, ১৩ সেপ্টেম্বর প্রত্যেক জেলায় ও শিল্পাঞ্চলে অবস্থান ও সংহতি সমাবেশ, ২৭ সেপ্টেম্বর পাট মন্ত্রণালয়ের সামনে বিক্ষোভ ও স্মারকলিপি এবং জেলায় জেলায় ডিসি অফিসের সামনে বিক্ষোভ ও স্মারকলিপি পেশ, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে মিছিল।

এরপরও দাবি মানা না হলে হরতাল, অবরোধসহ কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জোটের নেতারা ঘোষণা দেন।