কাজী জাফরকে নিয়ে বন্ধু-সহকর্মীদের ‘পুরনো দিনের গল্প’

পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রয়াত রাজনীতিক কাজী জাফর আহমেদকে নিয়ে ভার্চুয়াল আলোচনায় পুরনো দিনের গল্প শোনালেন তার বন্ধু-সহকর্মীরা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 August 2020, 11:58 AM
Updated : 29 August 2020, 11:58 AM

শনিবার এই আলোচনায় অংশ নেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, প্রবাসী শিক্ষাবিদ আতিকুর রহমান সালু ও আনিসুজ্জামান চৌধুরী।

‘ইতিহাসে সম্মুজ্জ্বল কাজী জাফর আহমদ’ শীর্ষক আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন কাজী জাফরের মেয়ে কাজী জয়া আহমেদ।

২০১৫ সালের ২৯ অগাস্ট মৃত্যুবরণ করা বন্ধু কাজী জাফরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “সে আমার বিশেষ বন্ধু ছিল। আমার ক্লাস ফ্রেন্ড ছিলে, আমরা একই ব্যাচের ছাত্র।

“আমি এসএম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম, কাজী জাফর এটার ছাত্র ছিল। সে প্রায় আসত, রাজনৈতিক কারণেই আসত। তখন দেখা-সাক্ষাৎ হত, আলাপ হত। হলকে উপলক্ষ করেই জানাশোনা শুরু হয়।বন্ধুত্ব হলেও বন্ধুত্ব একটা বিশেষ বন্ধুত্বে পরিণত হয়। তবে আমি ছাত্র রাজনীতি করিনি, কাজেই সেই দিক থেকে তার সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার কারণ ছিল না।”

গোপন রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম থেকে একটা পিআইয়ের ফ্লাইট ছিল ঢাকায় আসার মাঝখানে কুমিল্লায় থামত। একটা ফ্লাইটে আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসছি, কুমিল্লায় থামল। যারা কুমিল্লার যাত্রী তারা নেমেছে। কুমিল্লা থেকে ঢাকার যাত্রী উঠাল।

“তার মধ্যে লক্ষ্য করলাম দাঁড়ি-গোফওয়ালা একজন চাদর গায়ে আমার দিকে তাকাতে তাকাতে ঢুকল। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না-কেন তাকাল? যেই আমার পাশে আসল-মাথা নিচু করে বলল, আমি কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ডে আছি, আপনি কিছু বলবেন না। আমি এইমাত্র চিনলাম, আগে তো বুঝিনি…এই হচ্ছে কাজী জাফর।তখন বুঝলাম যে, আন্ডারগ্রাউন্ডটা কি জিনিস।”

স্মৃতিচারণ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “জাফর ভাই অসাধারণ নেতা ছিলেন, তার একটা মেমোরি ছিল, একটা অসাধারণ ক্ষমতা ছিল মানুষকে আপন করে নেয়ার এবং নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবার। আমাদের কাছে নায়ক ছিলেন, হিরো ছিলেন। সত্যি উনি একেবারে কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকতেন। তিনি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র, উনি সব সময় উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো রাজনীতিতে বিচরণ করছেন।

কাজী জাফর আহমদের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের একটি ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমরা জাতীয় পার্টিসহ তাকে আমাদের জোটে আনার জন্য কাজ করছিলাম। সেই সময়ে কয়েক দফা আমাদের সভা হয়েছে। প্রথম যে সভাটা উনি আমাদের ম্যাডামের সঙ্গে করতে গেলেন সেটা খুব স্মরণীয়। তখন সরাসরি ম্যাডামের সাথে দেখা করাটা তার জন্যে বিপজ্জনক ছিল।কারণ দলীয় প্রধান ও অন্যান্যরা জানতে পারলে তার ক্ষতি হতে পারে। এজন্য তিনি বললেন যে, আমি ছদ্মবেশে যাব। এখনও আমার মনে আছে, তিনি আবদুল্লাহ ভাইয়ের বাসায় ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন। আমি যখন প্রথম দেখলাম, তাকে চিনতে পারিনি। আচকান পরা, মাথায় টুপি, মুখে দাঁড়ি। আমাকে বললেন, কি চিনতে পারছ? আমার বেশ কিছু সময় লাগছে চিনতে। এরপর গাড়ি বদল করে ম্যাডামের বাসায় গিয়েছিলাম। জাফর ভাইকে সেদিন ম্যাডামও চিনতে পারেননি। ম্যাডাম বললেন, কাকে নিয়ে এলেন? উনাকে কিন্তু চিনতে পারছি না।”

রাশেদ খান মেনন বলেন, “জাফর ভাইয়ের সাথে আমার যে সম্পর্ক এটা দীর্ঘকালের একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে শ্রমিক আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তির আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন- সব ক্ষেত্রে আমরা প্রায় একত্রে পথ চলেছি।

“আমাদের সম্পর্কটা এতোই অবিচ্ছেদ্য ছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন আমরা ভারতে আশ্রয় নিয়ে এই লড়াইয়ে ক্ষেত্র সংগঠিত করার চেষ্টা করছি, সে সময়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজাফফর আহমদের সাথে আমার দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কমরেড মুজাফফর আহমদ আমাকে দেখে বললেন, ‘জাফর-মেনন আপনারা এসেছেন। আমি বললাম জি না, আমি মেনন, কাজী জাফর আরেকজন। উনি বললেন, ওহ জাফর-মেনন একটি নাম’।”

মেনন বলেন, “আমার একটি কথাই মনে আছে, ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনে যখন গুলি হল তখন ওয়াজি উল্লাহ, মামুন মুস্তফা মারা গেলেন। সেখানে সেই মেডিকেলের ভেতরে লাশের সামনে দাঁড়িয়ে যে বক্তৃতা করেছিলেন, আমার মনে আছে ওখানে দাঁড়ানো সমস্ত মানুষ কেঁদে দিয়েছিল। এতোদূর তার বক্তৃতার প্রভাব ছিল।

“ভিন্ন পথযাত্রায় আমরা স্বাধীনতার সূর্য দেখেছিলাম। সেই পথযাত্রায় আমাদের নেতা ছিলেন কাজী জাফর আহমেদ যাকে আমরা চিরকাল স্মরণ করি। যদিও রাজনৈতিক একেবারেই বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা, আকস্মিক মৃত্যর দিনেও আমার সৌভাগ্য হয়েছিল, তাকে শেষ বিদায় জানাতে পেরেছিলাম।”

কাজী জাফরের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে জাতীয় পার্টির উদ্যোগে জাতীয় প্রেস ক্লাবে স্মরণ সভা হয়। এতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, গণস্বাস্থ্য সংস্থার ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জাগপার একাংশের প্রধান খোন্দকার লুৎফুর রহমান, জাতীয় পার্টির আহসান হাবিব লিংকন প্রমুখ বক্তব্য দেন।