ডিলুর আসনে প্রার্থী হতে চান স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েসহ ৬ স্বজন

প্রয়াত সাবেক ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর আসন পাবনা-৪ এ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার জন্য দলীয় মনোনয়নপত্র তুলেছেন তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও জামাতাসহ ছয় স্বজন।

কাজী মোবারক হোসেনও সৈকত আফরোজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 August 2020, 04:55 PM
Updated : 27 August 2020, 07:29 PM

অপর দুজন ডিলুর খালাতো ভাই ও ভগ্নিপতি। এদের নিয়ে মোট ২৮ জন এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।

গত ২ এপ্রিল শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর মৃত্যুতে আসনটি শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। ১৯৯৬ সাল থেকে টানা পাঁচবারের এখান থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ডিলু। তার মৃত্যুতে শূন্য হওয়া এই আসনে উপনির্বাচনের প্রার্থী চূড়ান্ত করতে মনোনয়নপত্র বিক্রি শেষ করেছে আওয়ামী লীগ।

দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে কোনো দিন দলের মনোনয়ন বোর্ডের মাধ্যমে এই আসনসহ পাঁচটি শুন্য আসনের প্রার্থী চূড়ান্ত করবেন বলে জানিয়েছেন মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ।

তিনি বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে আগের মতো মনোনয়ন বোর্ডের সভা হবে না। সম্ভবত সীমিত পরিসরে কয়েকজনকে নিয়ে মনোনয়ন বোর্ডের সভায় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। আর সেটা অতি দ্রুতই করা হবে।”

আওয়ামী লীগের দপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, পাবনা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে লড়তে ডিলুর স্ত্রী ও ঈশ্বরদী উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুন নাহার শরীফ, বড় ছেলে ঈশ্বরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য গালিবুর রহমান শরীফ, বড় মেয়ে জেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মাহজেবিন শিরিন, শিরিনের স্বামী ঈশ্বরদী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঈশ্বরদী পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম আজাদ, শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর খালাতো ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বশির আহম্মেদ এবং ভগ্নিপতি ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা হাবিবুর রহমান দলীয় মনোনয়ন তুলেছেন।

ডিলুর এই ছয় স্বজনসহ মোট ২৮ জন এই আসনে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন বলে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান জানিয়েছেন।

একই পরিবার থেকে ছয়জনের মনোনয়ন চাওয়ার বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস‌্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, “এত ফরম বিক্রি হয়েছে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমাদের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু খুশি হতে পারিনি। তার কারণ হল- এমপি প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেতে হলে নিজের অবস্থানটা আগে বুঝতে হবে। জনগণের মাঝে আমার গ্রহণযোগ‌্যতা, আস্থা কতটুকু আছে। আমি জনগণের জন‌্য কী করেছি- এগুলো বিবেচনায় না এনে ফরম কেনা হচ্ছে নিজেকে এক ধরনের প্রচার করা। এই ব‌্যাপারগুলোতে আমি নিরুৎসাহিত করতে চাই।

“আমাদের শ্রদ্ধেয় নেতা দিলু ভাইয়ের মৃত‌্যুর পর তার পরিবার থেকে ৬ জনের মনোনয়ন ফরম কেনা দুঃখজনক, অনাকাঙ্ক্ষিত। আমার মনে হয়, মনোনয়ন ফরম কেনার ক্ষেত্রে কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ থাকা উচিত। তাহলে একটা শৃঙ্খলা আসবে।” 

এক আসনে এতজনের মনোনয়ন চাওয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, “একই আসনে এত প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত লজ্জাজনক। এটি সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা। প্রত্যেকেই এমপি হতে চায়। সকলেই সব কিছু পেতে চায়। এটি রাজনীতির জন্য অশনি সংকেত।”

তিনি বলেন, “রাজনীতিতে এখন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নেই। সাংগঠনিক শৃঙ্খলা থাকলে এক আসনের যোগ্য সর্বোচ্চ দুই থেকে তিনজন মনোনয়ন চাইতে পারে। যে যার মতো ফ্রি স্টাইলে মনোনয়ন ফরম তোলা শৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে না।

“এর মধ্যে অনেকের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। তারা লাইম লাইটে আসার জন্য মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। অনেকের চিন্তা, ফরম কিনে একবার দলীয় হাই কমান্ডের সামনে গেলে মনোনয়ন না পেলেও ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসার একটা সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। যত দ্রুত সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ফিরবে ততই এসব বিষয় কমে আসবে।”

বাবার আসনে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক ডিলুর ছেলে গালিবুর রহমান শরীফ (গালিব) করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে  ২৫ হাজার পরিবারকে খাদ্য সামগ্রী দিয়েছেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে আমি এবং আমার পরিবারের পক্ষ থেকে ঈশ্বরদী ও আটঘরিয়া এলাকায় ধারাবাহিকভাবে ত্রাণ বিতরণ করেছি। করোনা সংকটে এলাকার মানুষ এখনও বিপর্যস্ত। আমার বাবা সারা জীবন ঈশ্বরদী ও আটঘরিয়ার মানুষের পাশে থেকেছেন। এলাকার কোনো মানুষ এই দুঃসময়ে যেন না খেতে পেয়ে কষ্ট ভোগ না করে তাই আমরা এলাকার মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়ে এ যাবৎ ২৫ হাজার পরিবারের মাঝে ব্যক্তিগতভাবে ত্রাণ বিতরণ করেছি।”

দেশের বাইরে থেকে লেখাপড়া করে আসা গালিব বলেন, “আমি ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। ঈশ্বরদী-আটঘরিয়ার ৯৫ শতাংশ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতারা আমাকে সমর্থন দিয়েছেন বলেই আমি মনোনয়ন ফরম কিনেছি।”

এই আসনের মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বেশ কয়েকটি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ চলমান আছে, এসবের সঙ্গে বাবার স্মৃতি জড়িত আছে। সেজন্য কাজগুলো সফলভাবে সম্পন্ন করতে তাকে সাংসদ হিসেবে দরকার বলে মন্তব্য করেন গালিব।

গালিবের মা কামরুন নাহার শরীফ বলেন, “মনোনয়ন চাওয়ার অধিকার আমার আছে। দলেও অবস্থান ভালো। আমি মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি।”

গালিবের বোন মাহজেবিন শিরিন বলেন, “আমার বাবা ঈশ্বরদী-আটঘরিয়ায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। তিনি উন্নয়নের কাজ শেষ করে যেতে পারেননি। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই আমি মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি।”

এই আসনে দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহকারীদের মধ্যে রয়েছেন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল রহিম লাল, ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নুরুজ্জামান বিশ্বাস, সাবেক ডিজিএফআই প্রধান ও পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এএসএম নজরুল ইসলাম রবি, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও সাবেক সংসদ সদস্য পাঞ্জাব আলী বিশ্বাস, জেলা কমিটির উপদপ্তর সম্পাদক সৈয়দ আলী জিরু, পৌর আওয়ামী লীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক মিজানুর রহমান স্বপন, মৎস্যজীবী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুল আলিম, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রবিউল আলম বুদু, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বশির আহমেদ বকুল, মুসলিমা জাহান ময়না, জালাল উদ্দিন তুহিন,  সাবেক সংসদ সদস্য মঞ্জুর রহমান বিশ্বাস, ঈশ্বরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আকরাম আলী খান, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সদস্য অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান হাবিব, তাঁতী লীগের সহ-সভাপতি এস এম গোলাম মোস্তফা এবং সলিমপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৯ নম্বর ওয়ার্ড শাখার সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী।

মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রেজাউল রহিম লাল বলেন, “দলের প্রভাবশালী একটি পরিবারের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে পাবনা-৪ আসনে দল বার বার বিতর্কিত হয়েছে। সেখানে দলীয় কোন্দলও চরমে। নেত্রী আমাকে আসনটির দায়িত্ব দিলে আমি এসব সংকট কাটিয়ে দলীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হব।”

সাবেক সাংসদ পাঞ্জাব আলী বিশ্বাস বলেন, “নেত্রীর প্রতি আমার আস্থা আছে। গত নির্বাচনে আমাকে প্রার্থী করতে এলাকার মানুষ চাঁদা তুলে আমার ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করেছিল। এবারও তাদের চাপেই প্রার্থী হতে হয়েছে। দলীয় সভানেত্রী সবার কর্মকাণ্ড সম্পর্কেই অবহিত। তিনি অবশ্যই সঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন।”

এই আসন থেকে মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রবিউল আলম বদু ও দপ্তর সম্পাদক সৈয়দ আলী। ফরম নেওয়ার সময় দুজনই নিজেদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু বদু ও সৈয়দ আলী কোনো সময়ই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন না বলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।

মনোনয়ন ফরম নেওয়ার সময় আওয়ামী লীগের দপ্তরে প্রার্থীদের পরিচয় লিখে রাখা হয়, যা মনোনয়ন বোর্ডে উপস্থাপিত হয় বলে দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতির পরিচয় দেওয়ার কারণ জানার জন্য একাধিকবার ফোন করেও রবিউল আলম বদু ও সৈয়দ আলীকে পাওয়া যায়নি।