পাপুলের এমপি পদের ভবিষ্যৎ কী?

কুয়েতে মানবপাচারের মামলায় দুই বছর জেল হলেই বাংলাদেশের আইনপ্রণেতা কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকে সংসদ সদস্য পদ হারাতে হবে। 

সাজিদুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 August 2020, 06:44 AM
Updated : 3 August 2020, 11:54 AM

বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে মুক্তি পাওয়ার পর পাঁচ বছর পর্যন্ত তিনি আর সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্য বিবেচিত হন না।

কুয়েতে পাপুলের বিরুদ্ধে মানবপাচার, অর্থপাচার ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের শোষণের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা প্রমাণিত হলে সে দেশের আইনে তার পাঁচ থেকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে।

পাচারের শিকার পাঁচ বাংলাদেশির অভিযোগের ভিত্তিতে গত ৬ জুন মারাফি কুয়েতিয়া কোম্পানির অন্যতম মালিক পাপুলকে গ্রেপ্তার করে সে দেশের পুলিশ। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে বড় ধরনের নাড়া পড়ে গেছে কুয়েতের প্রশাসন আর রাজনৈতিক অঙ্গনে।

সাধারণ শ্রমিক হিসাবে কুয়েত গিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়া পাপুল ২০১৮ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর) আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

নির্বাচনে ওই আসনটি আওয়ামী লীগ তাদের জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু জাতীয় পার্টির প্রার্থী শেষ মূহূর্তে ভোট থেকে সরে দাঁড়ালে স্থানীয় আওয়ামী লীগ পাপুলের পক্ষে কাজ করেছিলেন। পরে জানা যায়, সেই ভোটে ছিল অনেক টাকার খেলা।

কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল ও তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম। ছবি: ফেইসবুক

পাপুল নিজে এমপি হওয়ার পর একই কায়দায় স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের কোটায় স্ত্রী সেলিনা ইসলামকে সংরক্ষিত আসনের এমপি করে আনেন।

পাপুলের মালিকানাধীন মারাফি কুয়েতিয়া গ্রুপে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি কাজ করেন বলে কুয়েতে বাংলাদেশি কমিউনিটির ধারণা। প্রবাসী উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকেও তার বড় অংকের শেয়ার রয়েছে।

পাপুল গ্রেপ্তার পর তার সংসদ সদস্যপদ নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়। সংসদের বাজেট অধিবেশনে বিএনপির এক সংসদ সদস্য বিষয়টি স্পিকারের গোচরে আনেন।

বিদেশের মাটিতে গ্রেপ্তার পাপুলের সংসদ সদস্য পদের ভবিষ্যৎ কী জানতে চাইলে সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে ‘সংসদে নির্বাচিত হইবার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা’ সম্পর্কে বলা আছে। সেখানে বর্ণিত বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে- কোনো ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং সংসদ-সদস্য থাকার যোগ্য হবেন না, যদি-

(ক) কোনো উপযুক্ত আদালত তাকে অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করে

(খ) তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর দায় হতে অব্যাহতি না পেয়ে থাকেন

(গ) তিনি যদি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোন বিদেশশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন

(ঘ) তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং মুক্তির পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়ে থাকে

কোনো সংসদ সদস্য গ্রেপ্তার, আটক বা কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী তা স্পিকারকে জানাতে হয়।

পাপুলের বিষয়ে সংসদের কাছে কী তথ্য আছে জানতে চাইলে স্পিকার বলেন, “কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী আমার কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য আসেনি।”

সংসদ সচিবালয়ের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাপুল যদি কুয়েতের আদালতে দণ্ডিত হন, কিংবা তাকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়, সেক্ষেত্রে তার আটক বা গ্রেপ্তারের বিষয়টি স্পিকারকে জানাতে হবে। সে অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে পাপুলের সদস্য পদ নিয়ে কোন বিতর্ক দেখা দিলে বিষয়টিতে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।

সংবিধানের ৬৬ (৪) অনুচ্ছেদেই বলা আছে, কোনো সংসদ সদস্য তার পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন কিনা, কিংবা সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুসারে কোনো সংসদ সদস্যের আসন শূন্য হবে কিনা, সে সম্পর্কে বিতর্ক দেখা দিলে শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য প্রশ্নটি নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠাতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।

পাপুল আটকের এক মাসের মাথায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেছিলেন ‘স্থানীয় অধিবাসী’ হিসেবেই তাকে আটক করা হয়েছে। সেই সময় প্রশ্ন ওঠে পাপুল কুয়েতের নাগরিকত্ব নিয়েছেন কি না।

বিএনপির এমপি হারুনুর রশীদও বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করেন। তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, পাপুল বিদেশি নাগরিক হলে তার সদস্য পদ থাকবে না।

কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল, ফাইল ছবি

তবে কুয়েত সরকারের তরফ থেকে পরে জানানো হয়, পাপুল তাদের দেশের নাগরিক নন। সেখানে তার বসবাসের অনুমতি আছে।

আবার কুয়েতের আদালতে রায় হওয়ার আগে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকতে হলেও সংসদের সদস্যপদ হারাতে পারেন পাপুল।

সংবিধানের ৬৭(খ) অনুচ্ছেদ অনুসারে স্পিকারের অনুমতি ছাড়া কোনো সদস্য টানা ৯০ কার্যদিবস সংসদে অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ শূন্য হবে।

তবে মহামারীর মধ্যে এবারের সংসদের বাজেট অধিবেশন শেষ হয়েছে কেবল নয় কার্যদিবস। ফলে ওই ৯০ কার্যদিবসের নিয়মে পড়ার আগে আরও অনেক সময় পাচ্ছেন পাপুল।

গত ২২ জুন একই লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর) আসনের সংসদ সদস্য পাপুল, স্ত্রী সেলিনা, মেয়ে ওয়াফা ইসলাম ও শ্যালিকা জেসমিনের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক দেশি-বিদেশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থাকা সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেয় দুদক।

এছাপড়া পাপুলের স্ত্রী, মেয়ে ও শ্যালিকার দেশত্যাগেও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি। পাশাপাশি পাপুল দেশে ফিরলে আর যেন বিদেশে যেতে না পারেন, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) চিঠি দেওয়া হয়েছে দুদকের পক্ষ থেকে।