‘এত বড় বেঈমান পৃথিবীতে বেশি নাই’

মহামারীর মধ্যে যখন চারপাশে মৃত্যুর আহাজারি, দুর্গতের দীর্ঘশ্বাস বাতাসকে ভারী করছে- সেই সময়ে চিকিৎসার নামে প্রতারণাকারী পৃথিবীতে খুব বেশি নেই বলে মনে করছেন মাহমুদুর রহমান মান্না।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 July 2020, 12:42 PM
Updated : 9 July 2020, 08:17 PM

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরীক্ষার নামে রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা ফাঁস হওয়া নিয়ে আলোচনার মধ্যে ভাইরাসের ভয়ে ইতালিতে বাংলাদেশিদের ঢুকতে না দিয়ে ফেরত পাঠানোর খবর প্রকাশের প্রেক্ষাপটে এই মন্তব্য করেন তিনি।

বৃহস্পতিবার এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় বিএনপির জোট শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মান্না বলেন, “আপনি এখান থেকে অনুমোদন দিয়েছেন হসপিটাল চালানোর জন্য, তাকে টেস্ট করতে দিয়েছে এই করোনাভাইরাসের এবং তার সনদ দেওয়া লোকজন বাইরে গেছে, গিয়ে ধরা খেয়েছেন…। সারা দুনিয়াতে বদনাম হয়েছে।”

রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ

আগের দিন বুধবার ইতালির রাজধানী রোমের ফিউমিচিনো বিমানবন্দরে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট নামার পর ওই উড়োজাহাজে থাকা ১২৫ বাংলাদেশিকে নামার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ওই উড়োজাহাজেই তাদের দেশের পথে ফেরত পাঠানো হয়েছে।

পরীক্ষা ছাড়াই করোনাভাইরাসের এই ভুয়া সনদ প্রদানকারী রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিতেন। সরকারের একাধিক মন্ত্রী, এমপি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও আমলাদের সঙ্গে তার ছবি ফেইসবুকে ঘুরছে।

এই প্রসঙ্গ টেনে মান্না বলেন, “সেই লোকটা যে আওয়ামী লীগের একজন মদদপুষ্ট লোক, আওয়ামী লীগের উচ্ছিষ্ট লোক। আর সে রীতিমতো গানম্যানসহ পুলিশ প্রটেকশন পেত। সরকার তাকে তৈরি করেছে। এ রকম একটা দুইটা না। আপনার এন-৯৫ ফাইভ মাস্ক কেলেঙ্কারি যারা করেছে তারাও।

“মানুষের যখন মৃত্যুর আহজারি, ক্ষুধার্তের আর্তনাদ সেই সময়ে মানবতার সাথে এত বড় বেঈমানি করার দল পৃথিবীতে বেশি নাই।”

আলোচনায় যুক্ত হয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও রিজেন্ট হাসপাতালের এই প্রতারণার জন্য ক্ষমতাসীনদের ‘আশ্রয়-প্রশয়কে’ দায়ী করেন।

তিনি বলেন, “একটা হাসপাতাল কী করে একটা মিথ্যা সার্টিফিকেট দিতে পারে? কালকে আমি দেখলাম একাত্তর টেলিভিশনে আমাদের সমস্ত মন্ত্রীরা তার (রিজেন্ট হাসপাতালের কর্ণধার মো. সাহেদ) সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত, অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলছেন, কাজ করছেন। অর্থাৎ পুরোপুরি সরকারের মদদ নিয়ে এই অপকর্মটা তারা করেছে।”

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে মির্জা ফখরুল বলেন, “তাদের যে পারফরমেন্স এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা সবাই দেখছি, ভোগ করছি প্রতি মুহূর্তে। সকালে উঠে শুনতে হয় মৃত্যুর খবর, আবার রাতে শোয়ার আগেও শুনতে হয় মৃত্যুর খবর।

“এভাবে মহামারীতে মৃত্যু হবে, কিন্তু তা কোনো রকমের প্রতিরোধ গড়ে উঠবে না এবং চরম উদাসীনতার মধ্য দিয়ে, অবহেলার মধ্য দিয়ে সরকার মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে- এটা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।”

এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে জাতীয় ঐক্য গড়ার বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব।

“সেই জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রকে রক্ষা করবার জন্য, জনগণের অধিকারকে রক্ষা করবার জন্য তাদের আজকে একটা জায়গায় আসতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে শুদ্ধ করে আনার জন্যে নির্বাচনকালীন সময়ে নিরপেক্ষ সরকার এবং এই সরকারকে চলে যেতে হবে-এই দাবি তুলতে হবে।”  

বক্তব্যে নির্বাচন কমিশনের রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন আইনের সংশোধনের উদ্যোগের সমালোচনা করে ফখরুল বলেন, “তাদের একটাই উদ্দেশ্য- আওয়ামী লীগকে বার বার ক্ষমতায় নিয়ে আসা, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখা। নির্বাচন কমিশন তারা তাদের দায়িত্ব পালন করছে, তারা তাদের প্রভুদেরকে ক্ষমতায় রাখার জন্য সমস্ত আইন তৈরি করছে।”

এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা এবং তাদেরকে ক্ষমতায় রাখার প্রক্রিয়াটি ২০০৭ সালের এক-এগারোর সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকার থেকে শুরু হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, “এই প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে এক-এগারো থেকে। বিরাজনীতিকরণের একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে- রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে, রাজনৈতিক দলগুলোকে একেবারে অকার্যকর করে। এখনও পরিকল্পিতভাবে সচেতনভাবে সেই কাজ চলছে।

“লক্ষ করে দেখবেন যে, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন একইভাবে নির্বাচন কমিশনগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করেছে সেই দায়িত্বটা ছিল যে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা।”

সংবিধান থেকে ‘নিরপেক্ষ সরকারের’ অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা বাতিল করার মধ্য দিয়ে ‘নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে’ ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট রিসার্চ অ্যান্ড কমিউনিকেশনের উদ্যোগে ‘রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন আইন: করোনাভাইরাস বিপর্যয়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের আবারো সংবিধানবিরোধী পদক্ষেপ’ শীর্ষক এই ভার্চুয়াল আলোচনা সভা হয়। আলোচকরা নিজ নিজ বাসা থেকে এতে যুক্ত হন।

‘সরকারের কাছে অর্থ নাই’

করোনাভাইরাস সংকটের মধ্যে দেশে ‘এক কোটির বেশি মানুষ’ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে মন্তব্য করে একে ‘বড় ক্রাইসিস’ বলছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মান্না।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না

তিনি বলেন, “প্রতিদিন ন্যূনতম ১০-২০টি পরিবার ঢাকা থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে। এদের রক্ষা করা হবে কীভাবে? সরকারের কোনো প্ল্যান নেই।

“গতকাল পত্রিকায় দেখেছেন যে, যেটাকে তারা (সরকার) বলেছেন সোশ্যাল সেফটিনেট বা করোনাকালে আক্রান্ত মানুষগুলোর সহযোগিতার জন্য দেওয়া হবে বিশেষ প্রণোদনা- এইগুলো দিয়ে এখন বেতন-ভাতায় বাড়ানো হচ্ছে। সমস্ত ব্যাপারে মিথ্যাচার করতে করতে… ।”

মান্না বলেন, “ওই যে বলত না, আকাশ দিয়ে উড়ে গেলে নিচে ঢাকার দিকে তাকালে লস এঞ্জেলেসের মতো শহর মনে হয়। সব উন্মাদ কতগুলো ফোরটোয়েন্টি ভদ্রলোক মন্ত্রী-টন্ত্রী হয়েছেন এবং উনারা একটার পর একটা কথা বলে ‍যাচ্ছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, সরকারের কাছে কোনো টাকাই নেই।

“সরকার টাকার জন্য কী করছে? প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, দেখেন তো ফরেন রিজার্ভ থেকে নেওয়া যায় কি না। ক্যান ইউ ইমাজিন দেশ কত বড় ক্রাইসিসে পড়লে ফরেন রিজার্ভে হাত দিতে চায়?”

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক সাংসদ জহিরউদ্দিন স্বপনের পরিচালনায় আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ২০ দলীয় জোটের মুখপাত্র নজরুল ইসলাম খান, বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব আবদুর রশিদ সরকার বক্তব্য রাখেন।