বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের পরামর্শে পাটকল বন্ধ হচ্ছে, অভিযোগ বাম জোটের

আশির দশকের পর থেকে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শে দেশে একের পর এক পাটকল বন্ধ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 July 2020, 11:48 AM
Updated : 2 July 2020, 04:17 PM

তারা বলছেন, বিশ্বে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। তাই ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলের যন্ত্রাংশ আধুনিকায়ন করলে শ্রমিক ছাঁটাই নয়, বরং নতুন শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।

রাষ্ট্রীয় পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল এবং পাটকল আধুনিকায়ন করার দাবিতে বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাম গণতান্ত্রিক জোটের বিক্ষোভ সমাবেশে এই অভিমত দেন তারা।

সমাবেশে জোটের প্রধান সমন্বয়ক ও বাসদ নেতা বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “আশির দশকে ৮২টি পাটকল ছিল জুট মিল করপোরেশনের অধীনে। কিন্তু পরে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ সারা দুনিয়ার নয়া উদারনীতিবাদের পরামর্শ হিসেবে সারা দেশে কাঠামোগত সমন্বয়ের কথা বলল। বাংলাদেশে পরামর্শ দিল, তোমরা বাংলাদেশের পাটখাত সমন্বয় কর। অর্থাৎ পাট খাত বন্ধ কর। ভারতকে বলল, তোমরা পাট খাতের উন্নয়ন কর। আমাদের ২৫ কোটি দিল, আর ভারতকেও ২৫ কোটি দিল। ভারতকে বলল নতুন নতুন পাটকল কর।

“বিশ্ব ব্যাংকের সাম্রাজ্যবাদী পরামর্শে সরকার একে একে পাটকলগুলো বন্ধ করা শুরু করল।”

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামীর মতোই এখন পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী ‘আচরণ করছেন’ বলে অভিযোগ করেন তিনি।

বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী বলেছিলেন, ‘অজগর বাংলাদেশের অর্থনীতি খেয়ে ফেলছে।’ তখন আমরা বুঝে গেছি, তারা পাট খাতকে ধ্বংস করতে চায়। তারা আদমজী বন্ধ করল।

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল ও পাটকল আধুনিকায়নের দাবিতে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিলের আগে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ করে বাম গণতান্ত্রিক জোট। ছবি: জয়ন্ত সাহা

“মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, তিনি মুক্তিযুদ্ধের নাম করে অবশিষ্ট ২৫টি পাটকল ধ্বংস করার জন্য চক্রান্ত করছেন। সে কারণে আমরা বলতে চাই, রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধা তারা আজকে একাকার হয়ে গেছে। তাদের সবার লক্ষ্য, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস ও লুটপাট করা।”

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর যন্ত্রাংশগুলোর ব্যালেন্সিং, আধুনিকায়ন, বিস্তার এবং প্রতিস্থাপন (বিএমআরই) করতে পারলে উৎপাদন তিন গুণ বৃদ্ধি করা যাবে বলে মনে করেন তিনি। 

বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “সেই ’৫১ সালে, ’৫৪ সালে কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছি। সে কারখানার যন্ত্রপাতি এত দিন চলে? সেগুলোকে বিএমআরই করা হয় না। আর বিএমআরই করলেও সেগুলো এখন আর নতুন হবে না। যন্ত্রপাতির উৎপাদন ক্ষমতা ১৮ টন ছিল, কমতে কমতে ৯ টনে নেমে এসেছে। কাজেই ৯ টন উৎপাদন ক্ষমতা দিয়ে কেমনে এই পাটশিল্প রক্ষা করবে?

“স্কপের পক্ষ থেকে সুপাশি করা হয়েছিল ১২০০ কোটি টাকা ব্যয় করে আধুনিকায়ন করতে, তাতে উৎপাদন তিন গুণ হত। শ্রমিক ছাঁটাই করতে হত না, তখন নতুন শ্রমিক নিয়োগ করা লাগবে।”

সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক বলেন, “সরকারি পাটকলগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হলে লক্ষ লক্ষ পাটচাষী সস্তায়  পাট বিক্রি করতে বাধ্য হবে।”

কাঁচা পাট রপ্তানির বিরোধিতাও করেন তিনি হামিদুল হক বলেন, “কোনো আহাম্মকও শিল্পের কাঁচামাল পাট বিক্রি করে না। শিল্পের কাঁচামাল কোথায় রপ্তানি হয়? বাংলাদেশের পাট রপ্তানি হয় চীন, ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তানে। আমরা কেন কাঁচাপাট রপ্তানি করব?

“সরকার বলেছে ৩৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ আছে। এত রিজার্ভ থাকলে পাটকল আধুনিক হয় না কেন? গত ৫০ বছরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে পাটকলগুলোকে।”

রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল ও পাটকল আধুনিকায়নের দাবিতে বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিল করে বাম গণতান্ত্রিক জোট। ছবি: জয়ন্ত সাহা

সিপিবির সহ-সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, “যে টাকা গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের জন্য বরাদ্দ হয়েছে সেই টাকা দিয়ে নিয়মিত শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন দেওয়া সম্ভব। ছাঁটাইয়ের কোনো প্রয়োজন হয় না। পাটকল বন্ধ করার কোনো প্রয়োজন হয় না।”

‘ভারতের স্বার্থে’ বাংলাদেশে পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

এই সিপিবি নেতা বলেন, “আমরা দেখেছি বিএনপির আমলে সাইফুর রহমান আদমজী পাটকল বন্ধ করে দিয়েছিল। কার স্বার্থে? ভারতের স্বার্থে, লুটেরা ধনিক শ্রেণির স্বার্থে। এখন আমরা দেখছি হাসিনা সরকার তারা পাটকল বন্ধ করে দিচ্ছে… ভারতের স্বার্থে, লুটেরা ধনিক শ্রেণির স্বার্থে। কোনো পার্থক্য নেই।”

বিজেএমসি ও পাটকল করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ‘চুরি-চামারি, লুটপাট  ও অব্যবস্থাপনার কারণে’ পাট শিল্পে বিপর্যয় নেমে এসেছে বলে অভিযোগ করেন চন্দন।

তিনি বলেন, “তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়ে আজকে পাটকল বন্ধ করে দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিককে পথে বসানোর পাঁয়তারা করছে। পাটকলের ২৫ হাজার কর্মচারী পরিচালনা করার জন্য সাড়ে ৩ হাজার কর্মকর্তা! আমরা এই মাথাভারী প্রশাসন কেটে ফেলার দাবি জানাই।”

সমাবেশ থেকে স্বাস্থ্য খাতে ‘অব্যবস্থাপনার’ সমালোচনা করেন বাম নেতারা।

বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “আজকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করে না, তাকে জানায় না। সিদ্ধান্ত কে নেয়? তাহলে তিনি বেহায়ার মতো কেন বসে আছেন? নিজে থেকে পদত্যাগ করার কথা… যদি কাণ্ডজ্ঞান থাকত, বিবেক থাকত, মানসম্মানবোধ থাকত।

“আজকে এই সমাবেশ থেকে অপদার্থ, অযোগ্য, বেহায়া স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছি।”

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশের পর বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করতে যান।

পরে শাহবাগ মোড়ে পুলিশ বাধা দিলে সেখানে পদযাত্রা থামিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন বাম নেতারা।