গরিবের ওপর চাপ সৃষ্টিকারী ধনীবান্ধব বাজেট: বলছেন বাম নেতারা

মহামারীর বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষার চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তার নানা দিক নিয়ে সমালোচনা করেছেন বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 June 2020, 09:47 PM
Updated : 11 June 2020, 09:47 PM

বাজেটকে ‘প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক, আমলাতান্ত্রিক ও গতানুগতিক’ বলছেন কেউ কেউ। বাজেটে পরোক্ষ কর বাড়িয়ে গরিবের ওপর চাপ সৃষ্টি করার পর বিপরীতে ধনীদের ছাড় দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তারা।  

অর্থমন্ত্রী বৃহস্পতিবার বিকালে জাতীয় সংসদে বাজেট উত্থাপনের পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও বাসদের নেতারা এই প্রতিক্রিয়া দেন।

বাজেট ৯৯ শতাংশ মানুষের ‘স্বার্থবিরোধী ও গতানুগতিক’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে।

এতে বলা হয়, “এই বাজেটে ১ শতাংশ লুটেরা ধনিকদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে। মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে আমলাতন্ত্রের সাজানো বাজেট ঘোষণা করেছে।”

করোনাভাইরাস মহামারীকালেও স্বাস্থ্য খাত উপেক্ষিত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন সিপিবি নেতারা, যদিও স্বাস্থ্য খাতে এবার গতবারের তুলনায় ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে

বাজেটের সমালোচনা করে তারা বলেন, “প্রস্তাবিত রাজস্ব আয়ে পরোক্ষ কর প্রত্যক্ষ করের দ্বিগুণ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এই দুঃসহ ভারের সবটাই বহন করতে হবে গরিব-মধ্যবিত্তসহ সাধারণ নাগরিকদের। অথচ বিত্তবানদের উপর ধার্য প্রত্যক্ষ কর হ্রাস করা হয়েছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর রেয়াত অব্যাহত রাখা হয়েছে, অপ্রদর্শিত কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এই বাজেটে এভাবে গরিব জনগণের সম্পদ মুষ্ঠিমেয় লুটেরা ধনিকের হাতে প্রবাহিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।”

এবারের বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬ শতাংশ।

এই বিপুল পরিমাণ বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঁধে ‘বিশাল ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে’ বাজেটের পরিমাণকে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা করেছে বলে মন্তব্য করেন তারা।

সিপিবি নেতারা বলেন, “এই অর্থের বেশিরভাগ খরচ হবে পূর্বেকার ঋণ পরিশোধ, শ্বেতহস্তির মতো বিশাল সিভিল-মিলিটারি প্রশাসনের রক্ষণাবেক্ষণ, বিলাস দ্রব্য আমদানি, অপচয়, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন প্রকারের সিস্টেম লস, কর-রেয়াতের নামে ধনিক শ্রেণিকে বিশাল ভর্তুকি প্রদান ইত্যাদি কাজে। এসবই হলো লুটেরা ধনিক শ্রেণির স্বার্থে গৃহীত পদক্ষেপ।

“এর বাইরে ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ এবারও অব্যাহত রাখার মাধ্যমে অর্থনীতিতে লুটপাটের ধারা আরও জোরদার করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ধনীকে আরো ধনী এবং গরিবকে আরো গরিব করা, ধন-বৈষম্য ও শ্রেণি-বৈষম্য বৃদ্ধি করা, সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্য বৃদ্ধি করা ইত্যাদি হবে এই বাজেটের ফলাফল। এই বাজেট জাতির অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নৈরাজ্য, অস্থিতিশীলতা ও নাজুকতা বাড়িয়ে তুলবে।”

বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প ও কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দিয়ে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা হলেও তা ‘প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক’ রয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।

তিনি বলেন, “ইতোমধ্যেই চলতি বছরের প্রবৃদ্ধির হিসাব ৫ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু কোভিড আক্রান্ত দেশ ও বিশ্বের অর্থনীতির এই পরিস্থিতিতে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কতখানি বাস্তবসম্মত সেটা ভেবে দেখার।

“উন্নয়ন ছয় মাস, এক বছরের জন্য নেমে থাকতে পারে, কিন্তু জীবন এক লহমার জন্য থেমে থাকতে পারে না। প্রবৃদ্ধিকে মানুষের জীবনের উর্ধ্বে স্থান দেওয়া সঠিক নয়।”

চলতি বাজেটে ব্যাংকিং খাত সংস্কার, সার্বজনীন পেনশন স্কিমের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, এবারের বাজেটে তা ‘অনুপস্থিত’ বলে মন্তব্য করেন রাশেদ খান মেনন।

তিনি বলেন, “এখনও বাজেটে অপ্রত্যক্ষ করই প্রধান যা সাধারণ মানুষকে আঘাত করে। সম্পদ ও মুনাফার উপরে কর আরোপ করা হল না। এদেশে ধনীদের আর কত ছাড় দেওয়া হবে?”

স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধিতে সন্তোষ প্রকাশ করলেও মেনন এ বরাদ্দকে ‘নিতান্তই অপ্রতুল’ মনে করেন।

তিনি বলেন, “এখন যখন কোভিড মোকাবিলায় আরও হাসপাতাল প্রয়োজন সেখানে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বসিয়ে রেখে এবং বেসরকারি খাতের মুনাফার কাছে ছেড়ে দিয়ে সেটা কি সম্ভব?”

বাজেটের আকার বাড়লেও তাতে কৃষি, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা, গবেষণা, কর্মসংস্থান খাতে বরাদ্দ ‘আনুপাতিক হারে তেমন বাড়েনি’ বলে মনে করছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান।

তিনি বলেন, “করোনাভাইরাস দুর্যোগে আক্রান্ত খাতগুলো আলোচনায় যতটা এসেছে বাজেটে ততটা মনোযোগ পায়নি।”

আয়কর নিয়ে তিনি বলেন, “উচ্চ আয়ের ক্ষেত্রে গত বাজেটে ৩০ শতাংশ কর ধার্য করা ছিল এবার সেটা কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। অথচ মাসে ২৫ হাজার টাকার উপর আয় করলে তাকে করের আওতায় আনা হয়েছে।”

“ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ পরোক্ষ কর দিতে বাধ্য হবেন। কিন্তু যারা সৎ-অসৎ নানা উপায়ে বিপুল সম্পদ ও প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে কর বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বরং উৎসে কর, কর্পোরেট করসহ নানা ক্ষেত্রে রেয়াত দেয়ার কথা বলা হচ্ছে।”

কালো টাকা সাদা করার সুযোগের সমালোচনা করে খালেকুজ্জামান বলেন, “বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে আগের চেয়ে আরো নমনীয় শর্তে। কিন্তু এ যাবৎ ১৬ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার পরও মাত্র ১৪ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে, যার মধ্যে ৯ হাজার কোটি টাকাই ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ফলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগে দুর্নীতি আরও বাড়বে।”

স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, কৃষি, খাদ্য, শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বরাদ্দ ‘প্রত্যাশিত না হওয়ায়’ প্রস্তাবিত বাজেট ‘গতানুগতিকতার গণ্ডিতে আটকে আছে’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ নেতারা।

বাজেট পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় দলটির সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এক বিবৃতিতে বলেন, “স্বাস্থ্য সেবা খাত ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে যতটুকু বরাদ্দ বেড়েছে সেটাও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কীভাবে ব্যয় হবে তা পরিষ্কার না। নতুন করে যারা কর্মহীন ও আয়হীন হয়েছে বা হবে তারা কীভাবে সামাজিক সুরক্ষা খাতে অন্তর্ভুক্ত হবেন সেটাও পরিষ্কার নয়। 

“কর্মসংস্থানসহ গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য পল্লী উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর বদলে কমানো হয়েছে। তাই এক কথায় বলা যায়, বাজেট প্রস্তাব গতানুগতিকতার গণ্ডিতে আটকে আছে।”