এরশাদের ‘দেউলিয়া’ বাজেট দেখছেন বিএনপির মঈন খান

করোনাভাইরাস সংকটে ব্যবসা-বাণিজ্য যেখানে স্থবির সেখানে এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি নিয়ে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন কীভাবে সম্ভব, সেই প্রশ্ন করেছেন বিএনপি নেতা আবদুল মঈন খান।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 June 2020, 04:36 PM
Updated : 15 June 2020, 06:16 AM

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল শুক্রবার বিকালে জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পর  তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি একথা বলেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, “এই সংকটকালে সরকার একটি বাজেট দিয়েছে যে বাজেট থেকে দেশের ১৭ কোটি মানুষের প্রত্যাশা ছিল অনেক। আমরা লক্ষ করলাম যে, অনেক বড় বড় প্রতিশ্রুতি এই বাজেটে থাকার পরেও এটা যেন একটা কথার ফুলঝুরি।

সাবেক মন্ত্রী মঈন খান বলেন, “পুরো বাজেটে এক তৃতীয়াংশই হল ঘাটতি, যা জিডিপির ৬ শতাংশ। এই প্রেক্ষিতে বর্তমান বাজেটটি ’৮০ দশকের এরশাদ সরকারের সময়ে দেউলিয়া বাজেটগুলোর কথাই মনে করিয়ে দেয়। বরং বিগত প্রায় ৩০ বছর ধরে প্রত্যেকটি সরকার এই প্রচেষ্টাই করেছে, বাজেট যত দূর সম্ভব স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর করা যায়।

“কেবলমাত্র দেশি-বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করে বাজেটে শুভংকরের ফাঁকি দিয়ে এই দুঃসময়ে দরিদ্র মানুষের জীবন ও জীবিকার সমাধান আগামী বাজেটে হবে- এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।”

করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষাপটে প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা লক্ষ করেছি বিভিন্ন খাতের তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বড় একটা বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন সেখানে নয়। বিগত এক দশকে আমরা দেখেছি হাজার হাজার কোটি টাকার মেডিকেল যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। তার সুফল করোনার প্রয়োজনে দেশের মানুষ পেল না। কাজেই প্রশ্ন হচ্ছে, বরাদ্দের পরিমাণ নয়, বরাদ্দের সঠিক ব্যবহার।

“যদি ২ হাজার টাকার পিপিই ৪৭০০ টাকায় কেনা হয় আর ডাক্তারদের ৫০০ টাকার চশমা ৫ হাজার টাকায় কেনা হয়, তাহলে স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়েও এদেশের মানুষের চিকিৎসা সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।”

বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিরোধিতা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মঈন খান বলেন, “আমরা বছরের পর বছর ধরে দেখছি, নামমাত্র কর দিয়ে অবৈধ সম্পদকে বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে দেশের অর্থনীতির কী উত্তরণ হয়েছে, তা এখনও পর্যন্ত কারও কাছে বোধগম্য নয়।

“এখন সময় এসেছে এই ধরনের অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে এই বিপদের সময়ে দেশের করোনা আক্রান্ত মানুষের স্বাস্থ্য সেবায় বিনিয়োগ করা।”

করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের রাজস্ব আদায় নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “বাজেটের বিরাট যে ঘাটতি সেটা কীভাবে কোথা থেকে পূরণ হবে, তার নির্দিষ্ট কোনো হিসাব-নিকাশ এই বাজেটে নেই। কেননা আমরা বর্তমান বছরে দেখেছি সরকারের রাজস্ব আয় ৩০ জুন নাগাদ প্রায় অর্ধেকে নেমে যেতে পারে এবং আসছে বছরে করোনা পরিস্থিতির যে দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল তাতে করে আগামী বছরেও রাজস্ব আদায় পরিস্থিতির এমন কোনো উন্নয়ন সাধিত হওয়ার লক্ষণ নেই।

“এই অবস্থায় বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বাজেটের মূল লক্ষ্য যেটা হওয়া উচিত ছিল, তা হল রাজস্ব ব্যয় সচেতনভাবে কমিয়ে আনা এবং সকল প্রকার অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া এবং এডিপিতে ২ লক্ষ ৫ হাজার কোটি টাকার যে বরাদ্দ তাকে সরাসরি অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে আসা। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন উন্নয়ন ব্যয় কমিয়ে আনলে কর্মসংস্থান ও জীবিকার সমস্যা হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এই যুক্তি ধোপে টেকে না।”

এর ব্যাখ্যা দিয়ে মঈন খান বলেন, “এডিপির ভেতরে যেসব ব্যয়ের তালিকা দেওয়া হয়েছে তা সবই বিপুলভাবে বর্ধিত হারে। আমরা অতীতে দেখেছি যে, একটি বালিশের মূল্য ৬ হাজার টাকা, একটি পর্দার মূল্য ৮৪ হাজার টাকা …। আইএমইডির মাধ্যমে যৌক্তিকীকরণ করলে উন্নয়ন বাজেট থেকে যে এক লক্ষ হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত হয়ে আসবে সেটা দিয়ে আমরা আগামী বাজেটের অত্যন্ত সহজে কোভিড-১৯ ক্ষতিগ্রস্ত কোটি কোটি কর্মহীন নারী-পুরুষ, প্রান্তিক কৃষক, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সমস্যার সমাধান খুব সহজে করতে পারি।”

জাতীয় সংসদে ডিজিটালি বাজেট উপস্থাপনার প্রসঙ্গ টেনে মঈন খান বলেন, “অবাক হয়ে লক্ষ করেছি, তৃতীয় কোনো ব্যক্তি টেলিভিশনের পর্দায় বাজেটটি বর্ণনা করেছেন, মাননীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য ফাঁকে ফাঁকে। এমনকি এটাও দেখা গেছে অন্যের দেওয়া বক্তব্যের প্রেক্ষিতে মাননীয় অর্থমন্ত্রী এক পর্যায়ে নিজেই টেবিল চাপড়াচ্ছেন।

“তাহলে একজন দর্শকের মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে এই বাজেট কি মাননীয় অর্থমন্ত্রী নিজে উপস্থাপন করেছেন, না অন্য কেউ?”

বাজেটে মানুষের জীবন-জীবিকা ‘উপেক্ষিত’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, বাজেটে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার ‘প্রতিফলন ঘটেনি’।

তিনি বলেন, “জনগণের জীবন, জীবিকা এবং মানবতার যে বিষয়টি আমি মনে করি সেটা এই বাজেটে উপেক্ষিত হয়েছে।”

মেগা প্রকল্পে বরাদ্দে সমালোচনা করে আমীর খসরু বলেন, “বাজেটে বড় বড় মেগা প্রজেক্টে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে যেগুলো এই মুহূর্তে প্রশ্নবিদ্ধ, সেগুলোর বিষয়ে অপেক্ষা করতে পারত, এটা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই বাজেটে আসার কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল না। অথচ দেশের মানুষের স্বাস্থ্য খাতে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা। সেগুলো অনেকটা বঞ্চিত হয়ে ওই সব প্রকল্পে টাকা যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, যে দুর্নীতির ধারা ছিল সেটাকে অব্যাহত রাখা।”

“একইভাবে বাজেটে যে কালো টাকাকে শুধু সাদা করা নয়, যে প্রক্রিয়ায় সাদার করার কথা বলা হচ্ছে সেটাও দুর্নীতিকে অব্যাহত রাখার একটা প্রয়াস আমরা দেখতে পাচ্ছি।”