তাদের কেউ বলছেন, সঙ্কটে পড়া জামায়াতের এটা টিকে থাকারই এক কৌশল। এর পেছনে ক্ষমতাসীনদের হাত রয়েছে বলে কারও সন্দেহ। কেউবা এর পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র দেখছেন।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে শীর্ষনেতাদের অধিকাংশের ফাঁসির পর টিকে থাকার লড়াইয়ে রয়েছে জামায়াত।
এর মধ্যে দলে সংস্কারের দাবি তুলে বহিষ্কৃত একটি অংশ গত বছর আলাদা প্ল্যাটফর্ম গঠন করেন। ঠিক এক বছর পর শনিবার তারা ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’ (এবি পার্টি)’ নামে নতুন দল গঠন করে বলছেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে চান।
এটাকে জামায়াতের ‘রাজনৈতিক কৌশল’ হিসেবেই দেখছেন একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জামায়াত যখনই কোনঠাসা হয়েছে বা বিপদে পড়েছে, তখনই তারা হয় গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করেছে, নেতৃত্বে পরিবর্তন করেছে, এমনকি দলের নামও পরিবর্তন করেছে।
“জামায়াতের বয়স হচ্ছে প্রায় ৮০ বছর। এই ৮ দশকে বহুবার জামায়াত খোলস পাল্টেছে। সাপ খোলস পাল্টায় সারভাইব (টিকে থাকার জন্য) করার জন্য। খোলস পাল্টানোর অর্থ এই নয়, সাপ নির্বিষ হয়ে গেছে। জামায়ত খোলস পাল্টায় নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য, টিকিয়ে রাখার জন্য।”
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে জামায়াতের ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ নামে আত্মপ্রকাশের কথা বলেন শাহরিয়ার কবির।
জামায়াত সঙ্কটে পড়ে নতুনভাবে গ্রহণযোগ্যতা তৈরির জন্য মানুষকে প্রতারিত করছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এটা আমাদের ক্ষোভের বিষয়, উদ্বেগের বিষয়। সরকারকে বলেছি, আমরা নাগরিক সমাজকে বলেছি এদের উপর কঠোর নজরদারী রাখার জন্য।”
মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রসঙ্গ টেনে শাহরিয়ার কবির বলেন, “মিশরে জামায়াতের জ্ঞাতিভাই হল মুসলিম ব্রাদারহুড। ওইটাকে যখন নিষিদ্ধ করা হল, তখন জাস্টিস পার্টি নামে একটি দলে তারা কেবল আত্মপ্রকাশই করেনি, ক্ষমতায়ও গিয়েছিল। ক্ষমতায় গিয়ে তারা মুসলিম ব্রাদারহুডের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করেছিল।
“সুতরাং এরা সুযোগ পেলে জামায়াতের রাজনীতিই চর্চা করবে। সেই গলা কাটবে, রগ কাটবে। ভিন্ন মতের, ভিন্ন ধর্মে যারা বিশ্বাসী, তাদের হত্যা করবে। এটাই হচ্ছে তাদের চরিত্র এবং বৈশিষ্ট্য।”
নতুন দলটির ‘মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার’ বাস্তবায়নের ঘোষণা নিয়ে তিনি বলেন, “এই যে আইনজীবী তাজুল (এ কে পার্টিতে যুক্ত হওয়া তাজুল ইসলাম), সেদিনও গণহত্যাকারীদের পক্ষে তিনি আদালতে লড়েছেন। বিচারের পর তিনি বলেছেন এই বিচার তিনি মানেন না। এই গণহত্যাকারীদের তারা শহীদ বলেছেন। এইটাই হচ্ছে জামায়াতের বৈশিষ্ট্য।
“তারা কি একাত্তরের ভূমিকার জন্য একবারও ক্ষমা চেয়েছে? চায়নি। তাজুল কি একবারও বলেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গণহত্যাকারীদের পক্ষে দাঁড়ানো আমার উচিৎ হয়নি? তারা এটা বলে নাই। সুতারাং এদেরকে বিশ্বাস করবার কোনো কারণ নেই।”
শাহরিয়ার কবিরের ভাষ্য, পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামির নির্দেশে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে সংস্কারপন্থিদের এই দলের আত্মপ্রকাশ।
“বাংলাদেশের জামায়াত কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের জামায়াতের একটা শাখা। এখন হয়ত পাকিস্তান থেকে নির্দেশ এসেছে, তোমাদের সেকেন্ড একটা উইং থাকা দরকার। সরকার যেকোনো সময় জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। বাংলাদেশের গঠনতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে একটা নতুন দল কর।
“যাই হোক, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি, এটা প্রকৃতপক্ষে সাপের খোলস পাল্টানোর মতো কিংবা নতুন বোতলে পুরনো মদ পরিবেশনের মতো।”
আওয়ামী লীগের জোট শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন মনে করেন, নতুন দলটি জামায়াতেরই নতুন রূপ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বহুদিন ধরেই খেয়াল করছি জামায়াতে ইসলামির মধ্যে কিছু বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে এবং অন্য নামে জামায়াতের নেতাকর্মীরা রাজনীতিতে আসার চেষ্টা করছে। এখন তারা কি রাজনীতি করে আগে তা দেখা উচিৎ।
“যদিও তারা বলছে স্বাধীনতার কথা। তার আগে তাদের একাত্তরের অন্যায়কে স্বীকার করতে হবে। এই দলের আহ্বায়ক যে সোলায়মান সাহেব তার যে ভূমিকা ছিল, এই ভূমিকা সম্পর্কে তো তাকে ব্যাখ্যা দিতে হবে। তার পরেই এই ধরনের দল করা যেতে পারে। তার আগে এটাকে জামায়াতের নতুন রূপ বলেই সবাই জানবে।
“এই দলের আহ্বায়ক যিনি হয়েছেন, কারোরই অজানা নয় যে কীভাবে তিনি সেসময় (একাত্তরে) ভূমিকা পালন করেছিলেন। সুতরাং হাত ধুয়ে ফেললাম, ব্যাপারটা এরকম না।”
এক প্রশ্নে মেনন বলেন, “যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের বিষয়টি সংসদে আমিই এনেছিলাম এবং সেটা গৃহিত হয়েছিল। কিন্তু আমি যেটা বুঝি নাই সেটা হল ট্রাইব্যুনালে কেন এই মামলাটি এগোলো না। এটা আমার বোধগম্য হয় নাই। তাছাড়া বারবার বলা হয়েছে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ বা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু এটা কখনোই কার্কর হয় নাই। কেন এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না, এটিও অজানা।”
সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন যেমন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। একাত্তরে সাম্প্রদায়িকতা এবং দ্বিজাতি তত্বের ভয়াবহ ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ করতে হয়েছিল। সে ভাইরাসকে আমরা পরাজিত করেছিলাম।
“সেই ভাইরাস নতুন চেহারা নিয়ে বা যে নাম নিয়েই আবির্ভূত হোক না কেন, একইভাবে তা প্রতিহত করতে হবে। সেই ভাইরাসের প্রেতাত্মা অন্য নামে আসলে সেটা একইভাবে ঘাতক ভাইরাস বলেই চিহ্নিত হবে। সরকার বা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এর পেছনে হাত আছে কি না, তা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ আছে-প্রশ্ন আছে।”
জামায়াতের সংস্কারপন্থিদের নতুন দল ঘোষণাকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক দেখছেন আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হিসাবে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার কথা হল, এটি একটি ষড়যন্ত্র। একটি কথা আছে না নতুন বোতলে পুরনো মদ, এরকম বিষয়টা।
“নতুন দলটির একজনকে তো আমি খুব ভালোভাবে চিনি, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। যুদ্ধাপরাধীদের মামলা চলছিল আপিল বিভাগে, আমি তখন আপিল শুনছিলাম। সে সময় তাজুল ইসলাম বেশ কয়েকদিন আপিল শুনানি করেছে। তারপর হঠাৎ সে উধাও হয়ে গেলেন। জানা গেল, কোনো এক ষড়যন্ত্র করার কারণেই তাকে পুলিশ খুঁজছে এবং এ জন্যেই সে উধাও হয়ে গেছে। সে তো পুরুপুরি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের একজন লোক।
“যে নাকি আহ্বায়ক হয়েছে, বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে সে সচিব ছিলেন। সুতরাং তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করবে, এটা একটা অসম্ভব কথা। ভূতের মুখে রাম নামের মতো অবস্থা।”
নতুন দল আত্মপ্রকাশের পেছনে জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী শীর্ষ নেতাদের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের ভূমিকা রয়েছে বলেও মনে করেন বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক।
তিনি বলেন, “আগের সব দায় থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই ছলেবলে তারা এই দলটি করেছে। এর পেছনে আছেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। যে ছিল যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষের প্রধান আইনজীবী। সিলেটে অনেক মুক্তিযোদ্ধা, নিরাপরাধ মানুষকে সে হত্যা করেছে একাত্তরে। এটা নিয়ে যখন তদন্ত শুরু হল, তখন কিন্তু সে পালিয়ে গেছে যুক্তরাজ্যে।
“এবং কিছুদিন আগে যুক্তরাজ্য থেকে একটা বিবৃতি দিয়ে বলেছে যে, জামায়াতে ইসলামীর সাথে সে আর নেই। এটি একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। আমি মনে করি, এর পেছনে তারেক জিয়ার পরিবারও জড়িত।”