‘মহাদুর্যোগ’ মোকাবেলায় জাতীয় টাস্ক ফোর্স এখন সময়ের দাবি: ফখরুল

নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে থাকায় একে ‘মহাদুর্যোগ’ আখ্যায়িত করে তা মোকাবেলায় এখই ‘জাতীয় টাস্ক ফোর্স’ গঠনের দাবি জানিয়েছে বিএনপি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 April 2020, 11:11 AM
Updated : 17 April 2020, 11:11 AM

শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই দাবি জানান।

তিনি বলেন, “চতুর্দিকে অন্ধকার ও হতাশা। করোনাভাইরাস দুর্যোগের নানামুখী প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি হবে বলে মনে হয়। এ পরিস্থিতি মোকাবিলার লক্ষ্যে সুসমন্বিত ও সুবিবেচিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ, ত্রাণ বিতরণ, বিভিন্ন সেক্টরে প্রণোদনা ও ঋণ প্যাকেজ বণ্টন ইত্যাদি বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার জন্যে একটি জাতীয় টাস্ক ফোর্স গঠনের প্রস্তাব আমরা করছি।

“এই টাস্ক ফোর্সে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিশিষ্ট সাংবাদিক, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, সশস্ত্র বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনীর প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করে একটি জাতীয় ঐক্যমত সৃষ্টি করে এই টাস্ক ফোর্সকে অর্থবহ ও গতিশীল করার মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি। আমাদেরকে লড়াই করতে হবে এবং সেই লড়াইয়ে অবশ্যই আমাদের জয়ী হতে হবে।”

টাস্ক ফোর্স গঠনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে ফখরুল বলেন, “এখন যে পরিস্থিতি টাস্ক ফোর্স গঠন করলে সুসমন্বিত, সুচিন্তিত ও সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক হবে। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের ভাষায়- কোনো খাদ্যের ঘাটতি নয়, খাদ্য বণ্টনে অনিয়ম, দুর্নীতি, সিদ্ধান্তহীনতা, সুশাসনের অভাব দুর্ভিক্ষের কারণ হতে পারে।

“তাই এখনই খাদ্য ও ত্রাণ বণ্টনে এবং করোনাভাইরাস পরবর্তী পুনর্বাসনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই প্রক্রিয়াটিকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।”

সংকট মোকাবেলায় অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো কী কী হতে পারে প্রশ্ন করা হলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “সবার আগে এখন স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও টেস্ট প্রয়োজন। রোগীদের স্বাস্থ্য সেবা দেওয়াটা সবার আগে। যাদেরকে আইসোলেশনে নেওয়া হচ্ছে এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যেটা সমস্যা দেখা দিয়েছে যারা দিন আনে দিন খায়- দিনমজুর যাদেরকে বলা হচ্ছে যে, ঘরে থাকো। ঘরে থাকলে তো খাওয়া আসছে না।

“এদের কাছে খাদ্য পৌঁছানো, তাদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা এবং তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়া উচিত, টপ অগ্রাধিকার পাওয়া প্রয়োজন। এটার জন্য উপযুক্ত হচ্ছে সামরিক বাহিনী। তারা স্থানীয় যে প্রশাসন আছে, জনপ্রতিনিধি আছে, রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনগুলো আছে তাদের নিয়ে এই কাজটা সহজে করা যেতে পারে। অতীতে দুই-একবার এই কাজগুলো হয়েছে তাদেরকে নিয়ে। তাদের (সামরিক বাহিনী) সাংগঠনিক যে দক্ষতা, তারা চুরি-টুরির মধ্যে থাকবে না- এই জিনিসটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সময়ে।”

বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমরা ঐক্যের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। বাম গণতান্ত্রিক জোট বা বাম মোর্চার ঐক্যের একটি পরামর্শ সভায়ও আমি যুক্ত হয়েছিলাম। আমরা কোনো রকমের সংকীর্ণতায় ভুগতে চাই না। আমরা মনে করি যে, এখন জাতীয় ঐক্যটা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন।”

বিএনপি কোনো কাজ করছে না বলে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীদের অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় ফখরুল বলেন, “বিষয়টা হচ্ছে যে, একটা রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে সরকার। সরকারের যদি জনগণের সাথে কোনো সম্পর্ক না থাকে, তাদের কোনো দায়-দায়িত্ব থাকে না, মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট থাকে না। যার ফলে এটা সরকার উপলব্ধি করছে না যে, এখন যেটা দরকার সবাইকে একখানে আনা।

“তাদের মধ্যে একটা ধারণা সৃষ্টি করা যে, আমরা যা কিছু করছি- ঐক্যবদ্ধভাবে করছি। ভারতে দেখুন, সেখানকার প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে কথা-বার্তা বলেছেন সমস্ত বিরোধী দলের সঙ্গে। অন্যান্য রাজ্যের চিফ মিনিস্টারের সাথে উনি কথা বলছেন, কথা বলেই কিন্তু তিনি হয়ত তার কাজটাই করছেন। কিন্তু আলাপ-আলোচনা করে নিচ্ছেন সকলের সঙ্গে। সো দ্যাট এভরি বডি উইল ফিল উই আর হিয়ার, উই আর অলসো কনট্রিবিউটিং। এটা খুবই প্রয়োজন তো।”

সেখানে বাংলাদেশ সরকার তা করছে না বলে অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “বিএনপি তো সবচেয়ে বড় দল। সেই বড় দলকে আপনি একেবারেই বাদ দিয়ে নিজের মতো করে কাজ করছেন, করেন। ফলো তো করছেন আমাদেরকেই দেখা যাচ্ছে। আমরা যা যা বলেছি সেই কাজগুলোই তো করছেন। সেইটাকে সুন্দর-সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করে এই গালিগালাজগুলো বাদ দিয়ে, ওই সমস্ত কথা-বার্তা বাদ দিয়ে আসল জায়গাতে আসুন। যেটা আমরা বার বার বলছি, দুঃস্থ মানুষকে বাঁচানো হচ্ছে বড় কাজ।

“কীভাবে আহাজারি করছে পোশাক শ্রমিকরা, কীভাবে আহাজারি করছে গৃহকর্মীরা, এরা অত্যন্ত দুঃস্থ হয়ে গেছে এখন কাজ নেই। যে বস্তিতে তারা থাকে সেখানে ঘর ভাড়া দেওয়ার উপায় নেই, সেখান থেকে তাদেরকে উচ্ছেদও করা হচ্ছে।

“গ্রামের দিনমজুর, ক্ষেতমজুর, যারা রিকশা চালায়, ঠেলা গাড়ি চালায় ওদের সংখ্যা তো তিন কোটি প্রায়। এই ইনফরমাল সেক্টরের লোকজনের কথা চিন্তা করতে হবে। এই যে ফেরি করতো হকার, বাজারে আসতো এসব কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে…..।” 

বিএনপির কাজের ফিরিস্তি

নভেলে করোনাভাইরাস সংকট শুরুর পর বিএনপি কী কী কাজ করেছে তার ফিরিস্তি দিয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, “করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আমরা এই বিষয়ে কথা বলেছি, আমরা জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য লিফলেট বিতরণ করেছি, তাদেরকে মাস্ক দিয়েছি। দুর্ভাগ্য আমাদের তথ্যমন্ত্রী সাহেব সেগুলো দেখতে পান না। তিনি বার বার বলে যাচ্ছেন এবং আওয়ামী লীগের লোকেরাও বলে যাচ্ছে যে, আমরা কিছু কাজ না করেই শুধু কথাই বলছি। এটা একেবারেই সত্য নয়।

“আমরা ইতোমধ্যে সারা দেশে আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২৪ মার্চ দলের নেতা-কর্মীদেরকে আহ্বান জানিয়েছিলেন যে, নিজেকে নিরাপদ রেখে দুঃস্থ ও দুদর্শাগ্রস্ত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা প্রত্যেকটা জেলা, উপজেলায় আমাদের দল, সহযোগী সংগঠন, অঙ্গ সংগঠনসমূহ তারা কাজ করছে। যুব দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্র দল, ড্যাব (ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন) ও জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে সর্বক্ষণ। সিলেটের প্রায় ৭০ হাজার পরিবারকে খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা মহানগরীর প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে আমাদের দলের নেতা-কর্মীরা খাদ্য বিতরণ করেছে।

“একইভাবে প্রত্যেকটি জেলা-উপজেলাতে যারা প্রার্থী ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন, এমপি ছিলেন তারা নিজেরাই নিজস্ব উদ্যোগে তাদের এলাকাগুলোতে দুঃস্থ মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করেছেন। আমার ধারণা যে, সারা দেশে কমপক্ষে ৫ লক্ষ পরিবারের কাছে আমাদের সাহায্য ইতোমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। এটা অব্যাহত রয়েছে এবং অব্যাহত থাকবে।”

গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সকালে এই সংবাদ সম্মেলন হয়। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক মাইনুদ্দিন আহমেদের  প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদেন করা হয়। এই সংকটে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, সামরিক বাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনী এবং গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের ভূমিকার প্রশংসা করেন বিএনপি মহাসচিব।

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন নসু, চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের সদস্য শায়রুল কবির খোকন ও শামসুদ্দিন দিদার উপস্থিত ছিলেন।