২৫ মাস পর মুক্তি, বাড়ি ফিরলেন খালেদা

দুর্নীতির দায়ে ২৫ মাস সাজা ভোগের পর ‘মানবিক বিবেচনায়’ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 March 2020, 09:23 AM
Updated : 8 May 2020, 10:33 AM

বুধবার বিকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর ভিড় আর স্লোগানের মধ্যে গুলশানের ভাড়া বাড়ি ফিরোজায় পৌঁছান সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

এ সময় তার পরনে ছিল ‘ট্রেডমার্ক’ হয়ে ওঠা গোলাপী জামা, চোখে সানপ্লাস, আর মুখে মাস্ক। ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার নিজে গাড়ি চালিয়ে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেন। সেখানে ফুল দিয়ে বিএনপিনেত্রীকে স্বাগত জানান স্বজনরা।  

পরে ফিরোজার সামনে নেতাকর্মীদের ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, “ম্যাডাম অসুস্থ। তার সাথে কথা বলে আমরা তার চিকিৎসকদের সাথে আলাপ করব। আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া তাকে বাসায় নিয়ে আসলাম। চিকিৎসকদের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।”

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ড নিয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাগারে বন্দি ছিলেন খালেদা জিয়া।

প্রথমে পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হলেও গত বছর ১ এপ্রিল থেকে তাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল।

এমন এক সময়ে তাকে মুক্তি দেওয়া হল,যখন নভেল করোনাভাইরাসের মহামারীতে পুরো বিশ্বজুড়ে চলেছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা; নানা বিধিনিষেধে বাংলাদেশও রয়েছে প্রায় অবরুদ্ধ অবস্থায়।   

বিএনপি নেতারা এতদিন খালেদার নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে এলেও মহামারীর মধ্যে এমন পরিস্থিতি তার মুক্তি নিয়ে এখন তাদের মনে শঙ্কাও কাজ করছে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের এই সময়ে চিকিৎসকদের পরামর্শে খালেদা জিয়া কিছুদিন কোয়ারেইটাইনে থাকবেন। নেতা-কর্মীদেরও তিনি কোয়ারেইটাইনে থাকতে বলেছেন।

বিএনপিনেত্রীর দণ্ডের কার্যকারিতা স্থগিত করে মুক্তির আদেশের নথি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারা কর্তৃপক্ষের হাত ঘুরে বুধবার বিকাল ৩টার পর বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে পৌঁছায়।

এরপর প্রয়োজনীয় অনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে মুক্তি দেওয়া হয় বলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুল হক বলেন, “উনাকে আমরা ৩টার দিকে ডিসচার্জ সার্টিফিকেট দিয়েছি। প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে উনি সোয়া ৪টার দিকে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান।

হাসপাতাল থেকে খালেদাকে তার গুলশানের বাসা ‘ফিরোজায়’ নিয়ে যেতে আগেই হাসপাতালের বাইরে এনে রাখা হয়েছিল গাড়ি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা এবং খালেদা জিয়ার পরিবারের কয়েকজন সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

কেবিন ব্লকে খালেদার মুক্তির অনুষ্ঠানিকতা শেষে নতুন একটি হুইলচেয়ার নিয়ে যাওয়া হয় ছয় তলার ৬২১ নম্বর কক্ষে। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে জমায়েত না করার বিষয়ে বারবার হুঁশিয়ারির পরও বিএনপি নেতাকর্মীরা হাসপাতালে ভিড় করলে পরিস্থিতি কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়ে।

পুলিশ ও বিএনপি মহাসচিবকে হ্যান্ডমাইকে বারবার নেতাকর্মীদের হাসপাতাল চত্বর থেকে সরে যেতে অনুরোধ জানানো হয়। বিকাল সোয়া ৪টার দিকে খালেদা জিয়াকে হুইল চেয়ারে করে নামিয়ে আনা হলে শত শত নেতা-কর্মীর ভিড় ডিঙয়ে তাকে গাড়িতে পৌঁছে দিতে হিমশিম খেতে হয় নিরাপত্তাকর্মীদের।

মুক্তি পেয়ে বুধবার বিকালে বিএসএমএমইউ হাসপাতাল থেকে বের হচ্ছেন খালেদা জিয়া। দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসনকে বয়স বিবেচনায় শর্ত সাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দিয়েছে সরকার। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি

যেভাবে মুক্তি

বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের চিকিৎসকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৭৫ বছর বয়সী খালেদা জিয়া ডায়াবেটিস, চোখের সমস্যায় ভুগছেন। তবে তার মূল সমস্যা গেঁটে বাত (অস্টিও-আর্থরাইটিস)। হাসপাতালে তাকে বিশেষ থেরাপি দেওয়ার কথা বলা হলেও তাতে তিনি সম্মতি দেননি।   

খালেদার জামিনের জন্য আইনজীবীরা গত দুই বছরে বহুবার আদালতে গেলেও জামিন মঞ্জুর হচ্ছিল না। বিএনপিকর্মীরা রাজপথে মিছিল-মানববন্ধন করছিলেন, কিন্তু তাদের নেত্রীর মুক্তির পথ খুলছিল না।

এই প্রেক্ষাপটে মার্চের শুরুতে ‘মানবিক কারণে’ খালেদার সাময়িক মুক্তি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। শামীম এবং তার সেজ বোন সেলিমা ইসলাম এ বিষয়ে কথা বলতে প্রধানমন্ত্রীর দেখা করেছেন বলেও খবর আসে সে সময়।

তার তিন সপ্তাহ পর মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, সরকার নির্বাহী আদেশে দণ্ডের কার্যকারিতা স্থগিত করে খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

শর্ত হল- এই সময়ে খালেদা জিয়াকে ঢাকায় নিজের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে। তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না।

সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক মঙ্গলবার শুধু বলেন, “খালেদা জিয়ার বয়স বিবেচনায় মানবিক কারণে সরকার সদয় হয়ে দণ্ডাদেশ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

আইন মন্ত্রণালয় তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে মঙ্গলবারেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায়। এরপর বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নথি যায় গণভবনে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল নিজেও সকালে গণভবনে যান।

সেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর বুধবার নথি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আসে। মন্ত্রণালয় তখন খালেদার মুক্তির বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে কারাগারে পাঠায়। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আদেশ পৌঁছালে মুক্তি মেলে বিএনপির তিন যুগের চেয়ারপারসন খালেদার। 

কারাগারে এবং পরে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের কেবিন ব্লকে ৬২১ নম্বর কেবিনে খালেদা জিয়ার পরিচর্যার জন্য তার গৃহকর্মী ফাতেমা বেগমকেও রাখার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, যা নজিরবিহীন। বুধবার খালেদার সঙ্গে ফাতেমারও ‘মুক্তি’ মিলেছে।  

মুক্তি পেয়ে বুধবার বিকালে বিএসএমএমইউ হাসপাতাল থেকে গুলশানের বাসভবনে পৌঁছান খালেদা জিয়া। ছবি: বাবুল তালুকদার

বাড়ি ফেরা

গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের ১ নম্বর হোল্ডিংয়ে ভাড়া বাড়ি ফিরোজায় খালেদা জিয়া বসবাস করছিলেন ২০১০ সাল থেকে। দুর্নীতি মামলার সাজায় তিনি কারাগারে যাওয়ার পর ১০ কাঠা জমির ওপর ওই দোতলা বাড়ি জনশূন্য হয়ে পড়ে।

গত দুই বছরে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী-সন্তানরা দুই দফা দেশে এসে ফিরোজায় উঠেছিলেন। বাকি সময় বাড়িটি খালিই ছিল। 

মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তির বার্তা দেওয়ার পর ফিরোজায় শুরু হয় সাফ-সুতরোর পর্ব।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বিএমএর সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন জানান,ওই বাড়ির গ্যাস ও টেলিফোন লাইন এখনও কাটা। তবে পানির লাইন  ঠিক করে ছাদের ট্যাংক পরিষ্কার করা হয়। রান্নার জন্য করা হয় গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবস্থা।

বিএনপি মহাসচিব ফখরুল এবং খালেদার ভাই শামীম বুধবার সকালে ফিরোজায় গিয়ে প্রস্ততি ঘুরে দেখেন। দুপুরের পর তারা চলে যান বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে।

এজেডএম জাহিদ হোসেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য সিরাজউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস ও যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেলও উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

খালেদা জিয়া মুক্তি পাওয়ার পর তাকে তোলা হয় শামীমের গাড়িতে। শামীম নিজেই গাড়ি চালিয়ে রওনা হন ফিরোজার পথে। শামীমের স্ত্রী কানিজ ফাতিমাও ছিলেন ওই গাড়িতে। পেছনে অন্য একটি গাড়িতে ছিলেন খালেদা জিয়ার কারাজীবনের সঙ্গী গৃহকর্মী ফাতেমা।

বিকাল সোয়া ৫টায় গাড়ি প্রবেশ করে খালেদার বাড়িতে। সেজ বোন সেলিমা ইসলাম, সেলিমার স্বামী রফিকুল ইসলাম, প্র্রয়াত সাঈদ এস্কান্দারের স্ত্রী নাসরিন এস্কান্দার, খালেদার বড় ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমানের বড় বোন শাহিনা খান জামান বিন্দুসহ পরিবারের সদস্যরা এ সময় ফুল দিয়ে তাকে স্বাগত জানান।

সেজ বোন ও ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর হাতে ভর করে গাড়ি থেকে নামেন খালেদা জিয়া। পরে তাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নেওয়া হয় বাড়ির ভেতরে।

বিএনপির কয়েকশ নেত-কর্মী তখন সড়কের দুই পাশে দাঁড়িয়ে তাদের নেত্রীর নামে স্লোগান দিচ্ছিলেন।