শনিবার বিকালে নয়া পল্টনে দলীয় জনসভায় এই ঘোষণা দিয়ে বিএনপি নেত্রীর মুক্তি দাবিতে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছেন তিনি।
সমাবেশে মির্জা ফখরুল বলেন, “আমরা অনেক কথা বলেছি, অনেক সভা করেছি, অনেক দাবি জানিয়েছি, নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। এখন আমাদের একটাই কথা, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে। সরকারকে বাধ্য করব দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে জনগণের সমস্ত অধিকার ফিরিয়ে দিতে-এটাই হচ্ছে এখন আমাদের একমাত্র কাজ।”
তিনি বলেন, “আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, সমস্ত জনগণের জেগে উঠার মধ্য দিয়ে, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই ভয়াবহ দানবকে পরাজিত করতে হবে এবং মানুষের অধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে।”
দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাবন্দি হয়ে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তার মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেও সুবিধা করতে পারেননি বিএনপি নেতারা।
খালেদার মুক্তি দাবিতে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আমাদের আন্দোলন শুরু হয়েছে। আমরা আবারও বলছি, অবিলম্বে দেশনেত্রীকে মুক্তি দিতে হবে। তা না হলে আপনাদের (সরকার) কর্মকাণ্ডের জন্য আপনারাই দায়ী হবেন, জবাবদিহি আপনাদেরই জনগণের কাছে করতে হবে।”
দলীয় প্রধানের কারাবাসের দুই বছরপূর্তির দিনে তার মুক্তির দাবিতে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এই সমাবেশ করে বিএনপি। কার্যালয়ের সামনের ফুটপাতে মঞ্চ তৈরি করে এই সমাবেশ হয়। সেখানে বিশাল ব্যানারে খালেদা জিয়ার বড় প্রতিকৃতি রাখা হয়। ব্যানারে লেখা ছিল ‘অবৈধভাবে কারাবন্দি করে রাখার ২ বছর: ক্ষমতাসীনদের প্রতিহিংসার নির্মম শিকার দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে সমাবেশ’।
সমাবেশ উপলক্ষে ফকিরেরপুল মোড় থেকে বিজয়নগরের নাইটেঙ্গল রেস্তোরাঁর মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ঢল নামে। বিকাল সাড়ে ৩টার মধ্যে হাজার হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে সমবেত হন। নেতা-কর্মীরা খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে নানা শ্লোগানের পাশাপাশি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলেও শ্লোগান দেন।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, “তিনি অত্যন্ত অসুস্থ, এত অসুস্থ যে তিনি এখন ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। তাকে সাহায্য নিয়ে চলতে হয়। তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেই। তার আর্থ্রাইটিসের সমস্যাও বেড়ে গেছে। তিনি ঠিকমতো খেতে পারেন না। কমপক্ষে ৬-৭ পাউন্ড ওজন কমে গেছে।
“দুই বছর সম্পূর্ণ বিনা কারণে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাকে আটক করে রাখা হয়েছে। আমাদের সবচেয়ে প্রিয় নেতা, যে নেতাকে মানুষ সার্বভৌমত্বের প্রতীক মনে করে, সেই নেতাকে যারা বন্দি করে রাখতে পারে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাদেরকে এদেশের জনগণ কোনো দিন ক্ষমা করবে না।”
আওয়ামী লীগ সরকার আইনের শাসনে ‘বিশ্বাস করে না’ অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “তারা নিজেরাই এই সংবিধানকে কেটে-ছেঁটে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। মানুষের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়েছে। আজকে জনগণের কোনো ম্যান্ডেট ছাড়াই শুধুমাত্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তারা ক্ষমতা জোর করে দখলদারির মতো টিকে আছে।এরা জনগণের সরকার নয়।
“আমাদের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা যুদ্ধ করে যে স্বাধীনতা এনেছি, যে চেতনার ওপর ভিত্তি করে সেই গণতান্ত্রিক চেতনাকে তারা ধ্বংস করে দিয়েছে।”
আওয়ামী লীগ দেশকে একটি ‘অকার্যকর রাষ্ট্রে’ পরিণত করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
“যে দেশে তারেক রহমানকে একটা আদালতের বিচারক বেকসুর খালাস দিয়ে দিলেন তখন সেই বিচারককে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, সেই দেশে ন্যায়বিচার কেউ পেতে পারে না। এভাবে বিচার বিভাগকে ধ্বংস করে দিয়েছে, প্রশাসনকে সম্পূর্ণ দলীয়করণ করেছে।”
এই মাসেই অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে ফখরুল বলেন, “মাত্র ১৫% ভোট পেয়ে কোনো দিন মেয়র হওয়া যায় না, জনগণের প্রতিনিধি হওয়া যায় না। আমাদের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, মেশিন দিয়েও পৌঁছাতে পারে নাই। সব নির্বাচনে নিয়ম আছে যদি ৫০ শতাংশের নিচে ভোট পড়ে তাহলে সেটাকে নির্বাচন বলে গণ্য করা যায় না।”
ফলাফল বাতিল করে পুনরায় সিটি করপোরেশনের দাবি জানরান তিনি।
এই সরকার দেশ পরিচালনায় ‘ব্যর্থ হয়েছে’ অভিযোগ করে অবিলম্বে পদত্যাগ করে ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচন কমিশনের অধীনে জাতীয় নির্বাচন দেওয়ারও দাবি করেন বিএনপি মহাসচিব।
“অন্যথায় জনগণের উত্তাল তরঙ্গে আপনারা ভেসে যাবেন।”
জনসভায় বক্তব্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘গায়ের জোরে’ আওয়ামী লীগের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতেই তাদের নেত্রীকে কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে।
“আপনারা জানেন, দেখেছেন ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন জনগণ বয়কট করেছিল, কেউ ভোট দেয়নি। তারপরও এই সরকার গায়ের জোরে ক্ষমতায় বসেছে। যখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে। এই সরকার মনে করেছে, দেশনেত্রী যদি বাইরে থাকেন তার নেতৃত্বে এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। তাই তারা একাদশ সংসদ নির্বাচনের পূর্বে দেশনেত্রীকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে।”
ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগের ওপর প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ তুলে সাবেক আইনমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, “যেদিন বেগম খালেদা জিয়ার জামিনের শুনানি হবে সেই দিন প্রধানমন্ত্রী বললেন, খালেদা জিয়া রাজার হালে আছেন। এ কথাটা শুনার পরে কোনো বিচারপতির জন্য তাকে জামিন দেওয়া সম্ভবপর? এভাবে বিভিন্নভাবে তারা প্রভাবিত করে আদালতকে, যার কারণে তিনি কারাবন্দি অবস্থায় আছেন। তবে এই অবস্থা চিরদিনের অবস্থা নয়।”
“এই রাজপথেই আন্দোলনের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আসবে। এই মুক্তির সাথে সাথে দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসবে, মানুষের ভোটের অধিকার ফিরে আসবে, আইনের শাসন ফিরে আসবে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ফিরে আসবে।”
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, “যে দুইজন মেয়র হয়েছেন তারা মেশিনের মেয়র। আর আমাদের তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেন জনগণের মেয়র। তাও আবার তারা মেশিন দিয়েও ২৭% ভোট দেখাতে পারেন নাই।”
এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে প্রত্যাখ্যানের প্রমাণ মিলেছে বলে মন্তব্য করেন মওদুদ আহমদ।
“এই যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া, তা কোনো দিনই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে না- এটা এদেশের মানুষ আবার প্রমাণ করেছে।”
সরকার বিএনপি নেত্রীকে ন্যূনতম ‘সম্মান দেখাচ্ছে না’ অভিযোগ করে তিনি বলেন, “তিলে তিলে তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। আমরা বলব, আল্লাহ‘তালা তাকে দীর্ঘজীবন দান করুন। ইনশাল্লাহ, আজকে যে জনতার টেউ, জনতার মিছিল, বাংলার গ্রাম-গঞ্জ থেকে শুরু হবে এবং শেখ হাসিনার তখতে তাউস নাড়াতে হবে, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্ত হবেন।”
নেতা-কর্মীদের সব বিভেদ ভুলে নিজ নিজ এলাকায় সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান মির্জা আব্বাস।
বিএনপি মহাসচিবের সভাপতিত্বে ও প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সহ-প্রচার সম্পাদক আমীরুল ইসলাম খান আলিমের পরিচালনায় সমাবেশে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, জ্যেষ্ঠ নেতা বরকতউল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, শাসুজ্জামান দুদু, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, মিজানুর রহমান মিনু, ফজলুর রহমান, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, আবদুস সালাম, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন এবং ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ধানের শীষের দুই মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেন বক্তব্য রাখেন।
সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে যুব দলের সাইফুল আলম নিরব, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, মহিলা দলের আফরোজা আব্বাস, স্বেচ্ছাসেবক দলের শফিউল বারী বাবু, আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল, মুক্তিযোদ্ধা দলের ইশতিয়াক আজিজ উলফাত, শ্রমিক দলের আনোয়ার হোসেইন, ছাত্র দলের ফজলুর রহমান খোকন, ইকবাল হোসেন শ্যামল প্র্রমুখ নেতারা বক্তব্য দেন।
মঞ্চে থাকা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি বক্তব্য দেননি।
সমাবেশে আবদুল আউয়াল মিন্টু, আতাউর রহমান ঢালী, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, শ্যামা ওবায়েদ, বিলকিস জাহান শিরিন, শিরিন সুলতানা, এহছানুল হক মিলন, এম এ মালেক, মীর সরফত আলী সপু, আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী, নিপুণ রায় চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।