খালেদার কারাবাসের দুই বছর, কাঠগড়ায় নেতারা

প্রায় চার দশকের রাজনৈতিক জীবনে দেশের প্রধান দুই দলের একটির নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি দেশেরও নেতৃত্ব দিয়েছেন দশককাল, সেই নেত্রীর শেষ বয়সে দীর্ঘদিনের কারাবাস মেনে নিতে পারছেন না কর্মীরা।

সুমন মাহমুদ প্রধান রাজনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Feb 2020, 02:59 PM
Updated : 7 Feb 2020, 04:46 PM

দুর্নীতির সাজায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাবন্দিত্বের দুই বছর পূর্তিতে দ্রুত তার মুক্তি চাওয়ার সঙ্গে এতদিনে তাকে ‘বের করতে না পারার জন্য’ দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের দায়ী করেছেন তারা।

সরকারের সঙ্গে ‘যে কোনোভাবে বোঝাপড়ার’ মাধ্যমে নেত্রীকে কারাগার থেকে মুক্ত করার কথা বলেছেন তাদের কেউ কেউ। আর দলটির শীর্ষ নেতাদের কথায় স্পষ্ট, তারা এখনও এ বিষয়ে কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছেন না।

জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। প্রথম ১৩ মাস ছিলেন পুরান ঢাকার পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে একমাত্র বন্দি হিসেবে।

সেখানে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত বছরের ১ এপ্রিল চিকিসার জন্য খালেদাকে নিয়ে আসা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। গৃহকর্মী ফাতেমাকে নিয়ে এখনও ওই হাসপাতালের কেবিন ব্লকে আছেন তিনি।

আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিসসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত খালেদা জিয়া ‘গুরুতর অসুস্থ’ এবং এখন তিনি অন্যের সাহায্য ছাড়া হাঁটা-চলা, এমনকি খেতেও পারেন না বলে স্বজনদের ভাষ্য। এভাবে চলতে থাকলে খালেদার জীবনশঙ্কা তৈরি হবে বলে মনে করছেন তারা।

ওই হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সুষ্ঠু চিকিৎসা হচ্ছে না অভিযোগ করে তাকে বিশেষায়িত কোনো বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়ার দাবি করে আসছেন বিএনপি নেতারা। তবে তাদের দাবি নাকচ করে সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, দেশের সেরা হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে খালেদার, রাজনৈতিক কারণে তার অসুস্থতা নিয়ে বাড়িয়ে বলছেন দলের নেতারা।

খালেদা জিয়াকে নিয়ে দলটির নেতাদের উদ্বেগ নাকচ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, হাসপাতালে ‘রাজার হালেই’ আছেন বিএনপি নেত্রী।

খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে শুক্রবার ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় লিফলেট বিতরণ করেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।

সরকারের পক্ষ থেকে যা-ই বলা হোক না কেন, তাতে ভরসা পাচ্ছেন না বিএনপির তৃণমূলের কর্মীরা। অবিলম্বে নেত্রীর মুক্তির ব্যবস্থা করতে দলের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

পুরান ঢাকার পান দোকানি বিএনপিকর্মী আলী আক্কাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৩৭ বছর ধরে আমি বিএনপির রাজনীতি করি, কখনও নেতা হইনি। আমি মনে করি, ম্যাডাম বিএনপির জীবনীশক্তি, কর্মী-সমর্থকদের মনের শক্তি। তাকে নেতারা দুই বছরেও কেন মুক্ত করতে পারলেন না, জানি না।

“আমি নেতাদের কাছে একটাই আবদার করতে চাই, যেভাবেই হোক সরকারের সাথে একটা লাইন করে ম্যাডামকে বের করে আনুন, তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন।”

খালেদার বিষয়ে নেতাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গুলিস্তান হকার্স মার্কেটের ফুটপাতের শার্ট বিক্রেতা বিএনপিকর্মী মো. হাফিজ।

নারায়ণগঞ্জের এই বাসিন্দা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা নেতা তাদের কাজটা কী? কেন সরকারের সাথে তারা ম্যাডামের মুক্তির ব্যাপারে একটা কিছু করতে পারলেন না?

“জানি, এই সরকারের দয়া-মায়া বলে কিছু নাই। তারা কোর্ট-কাচারিকে বন্দি করে রেখেছে। কিন্তু এ রকম পরিস্থিতিতে কীভাবে একটা রাস্তা পাওয়া যাবে, তা তো নেতাদেরই ঠিক করতে হবে।”

শান্তিনগরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচ্ছন্নতাকর্মী কুলসুম বেগম বলেন, “দেশনেত্রী ম্যাডাম খালেদা জিয়া বিএনপির বাতিঘর। যেভাবেই হোক তার মুক্তির পথ জলদি বের করতে হবে। দুই বছর গেছে, কত মাস গেছে, দিন গেছে, রাত গেছে, আর কত অপেক্ষায় থাকব আমার নেত্রীর জন্য?”

খালেদা জিয়ার আরোগ্য কামনা করে শুক্রবার জুমার পর ঢাকাসহ সারা দেশের মসজিদে মসজিদে দোয়া মাহফিল করে বিএনপি।

পল্টন জামে মসজিদে দোয়া শেষে বেরিয়ে বিএনপির কর্মী আমজাদ হোসেন বলেন, “জানি না, ম্যাডাম কেমন আছেন? দোয়া করেছি উনি যেন সুস্থ থাকেন।”

চেয়ারপারসনের মুক্তি দাবিতে সকালে ঢাকার শাহবাগ, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় লিফলেট বিতরণ করেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা।

খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে এ রকম বহু কর্মসূচি পালন করেছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।

দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে বেআইনিভাবে বিচার ব্যবস্থাকে করায়ত্ত্ব করে মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় সাজা দিয়েছে এবং এখন তাকে তার সাংবিধানিক যে প্রাপ্য জামিন পাওয়া সেটাও দিচ্ছে না। আমরা বার বার আদালতে গিয়েছি কিন্তু সেটা কী হয়েছে আপনারা সবই জানেন, দেখছেন।

“আমরা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলনের মধ্যে আছি, আমরা আন্দোলন করছি। দেশনেত্রীর ওপর যে নির্যাতন চলছে তার দুই বছরপূর্তিতে আগামীকাল আমরা নয়া পল্টনে সমাবেশ করব।”

‘গুঞ্জন’

খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সর্বশেষ জামিন আবেদন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ খারিজ করে দেওয়ার পর আপাতত আইনি পথে তার মুক্তির সুযোগ নেই। কিন্তু গত ২৪ জানুয়ারি হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে তার বোন সেলিমা ইসলাম এ বিষয়ে সরকারের কাছে ‘বিশেষ আবেদন’ করার ইঙ্গিত দেন।

তিনি বলেছিলেন, “আমরা এখনও আবেদন করিনি। আমরা ভাবছি আবেদন করব। তবে এখনও ঠিক করিনি এটা। কারণ তার যে শরীরের অবস্থা। এভাবে চলতে গেলে বেশি দিন উনাকে জীবিত অবস্থায় আমরা বাসায় নিয়ে যেতে পারব না। যে কোনো সময়ে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।”

এরপর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে, আবেদন করলে ‘প্যারোলে মুক্তি’ পেয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার সুযোগ পেতে পারেন খালেদা জিয়া।

এর আগেও একবার খালেদার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন তাদের নেত্রীর শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় প্যারোলে মুক্তির বিষয়ে কথা তুললে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছিলেন, ওই আবেদন করলে বিবেচনা করে দেখবেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বিএনপির ঢাকা মহানগর কমিটির একজন নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা শুনেছি ম্যাডামকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে পরিবারের একটা আলোচনা চলছে। আমরা চাইছি, তা যেন সত্যি হয়।”

তবে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে কোনো অগ্রগতি হয়েছে কি না- সে প্রশ্নে মুখ খুললেন না স্বজনদের কেউ।

এ বিষয়ে জানতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম যোগাযোগ করে। তাদের সবারই এক কথা, পারিবারিক যে উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে, সে সম্পর্কে তারা ‘সেভাবে কিছুই জানেন না’।

কারা তত্ত্বাবধানে প্রায় এক বছর বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা গুরুতর বলে স্বজনদের ভাষ্য

তিন ডজন মামলার আসামি খালেদা

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাঁচ মামলাসহ মোট ৩৬টি মামলা রয়েছে বলে তার অন্যতম আইনজীবী মাহবুবউদ্দিন খোকন জানিয়েছেন।

দুর্নীতির মামলাগুলো হল- জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট মামলা, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা, নাইকো মামলা, গ্যাটকো মামলা ও বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি মামলা।

এসব মামলার সবগুলোই দায়ের হয়েছিল ২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। সে সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের এই মামলাগুলোর মধ্যে জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় এরইমধ্যে দণ্ডিত হয়েছেন খালেদা জিয়া।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে খালেদার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হলেও আপিলে তা বেড়ে ১০ বছর হয়েছে। অপরদিকে ওই বছরই জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড হয় সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর। তার দুর্নীতির বাকি তিনটি মামলা এখনও বিচারাধীন।

এর বাইরে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ২০১৪-১৫ সালে বিএনপির আন্দোলনে নাশকতার বিভিন্ন ঘটনা, মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহ ও ভুয়া জন্মদিন পালনের অভিযোগে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে আরও ৩১টি মামলা রয়েছে।

খালেদা জিয়ার ৩৮ বছরের রাজনৈতিক জীবনে মামলায় সাজা নিয়ে টানা দুই বছরের কারাবাস এবারই প্রথম হলেও আরও একবার প্রায় এক বছর তিনি কারাবন্দি ছিলেন। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে গ্রেপ্তার হয়ে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে সংসদ ভবন এলাকায় বিশেষ কারাগারে ছিলেন তিনি।

এর আগে আশির দশকে এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৭ সালে খালেদা জিয়াকে সেনানিবাসের শহীদ মইনুল সড়কের বাসায় গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। ১৯৮৭ সালে পূর্বানী হোটেলে দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের সময় খালেদা জিয়াকে আটক করেছিল পুলিশ, সেই প্রথম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। 

গুলশানের এই বাড়িতে থাকতেন খালেদা জিয়া; দুই বছর ধরে নির্জন, সুনশান এক সময় নেতাকর্মীদের পদচারণায় সরগরম বাড়ির সামনের এলাকা

ফিরোজায় আর কেউ যায় না

২০১০ সালের নভেম্বরে সেনানিবাসের বাড়ি ছাড়ার পর গুলশান এভিনিউয়ের ৭৯ নম্বর সড়কের যে বাড়িতে উঠেছিলেন খালেদা জিয়া, তারই নাম ‘ফিরোজা’।

বিএনপি প্রধান কারাগারে যাওয়ার আগের দিন ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারিও নেতা-কর্মীদের পদচারণায় সরগরম ছিল এই বাড়ির সামনের সড়ক।

তবে শুক্রবার সকালে গিয়ে দেখা গেল একেবারেই নির্জন, নিঃশব্দ একটি বাসা। প্রধান ফটক বন্ধ। চার নিরাপত্তাকর্মী পালাক্রমে পাহারা দেন এই শূন্য বাড়িটি। বাসায় গত দুই বছর ধরে কেউই থাকেন না বলে জানান তারা।

দোতলা বাড়ির সবগুলো দরজা-জানালা বন্ধ। বাসার সামনের ছোট সবুজ প্রাঙ্গণটি ঠিক আগের মতোই রয়েছে, সেখানে ৫-৬টি শুকনো পাতা পড়ে থাকতে দেখা গেল।

একজন নিরাপত্তাকর্মী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন এই বাসায় কেউই থাকেন না। বলতে গেলে একেবারেই শূন্য। তবে গেল জানুয়ারি মাসের শেষদিকে ম্যাডামের ছোট ছেলে মরহুম কোকো স্যারের স্ত্রী সিঁথি আপাসহ (শর্মিলা রহমান সিঁথি) তার দুই মেয়ে এসেছিলেন বিদেশ থেকে, এই বাসায় ছিলেন ১২ দিন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি তারা চলে গেছে বিদেশে।”

অনেক দিন ধরে এই বাড়ির গ্যাস লাইন ও টেলিফোন সংযোগ বিছিন্ন রয়েছে বলে জানান তিনি।

বিএনপির কর্মসূচি

কারাগারে যাওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়ার ‍মুক্তি দাবিতে গত দুই বছরে মানববন্ধন, প্রতীকী গণঅনশন, গণঅবস্থান, বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ, গণস্বাক্ষরতা অভিযান, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে স্মারকলিপি প্রদানসহ নানা কর্মসূচি বিএনপি পালন করলেও সুবিধা করতে পারেনি।

এখন খালেদার বন্দিত্বের দুই বছর পূর্তিতে শুক্রবার সারা দেশে মসজিদে মসজিদে দোয়া মাহফিলের পর শনিবার দুপুরে নয়া পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করবে বিএনপি।

বিএনপিসহ কয়েকটি দল নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও শনিবার সকাল ১১টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে প্রতিবাদ সভার কর্মসূচি দিয়েছে।