ভোটের ব্যবচ্ছেদ করে পুনর্নির্বাচন দাবি তাবিথ-ইশরাকের

ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা এবং ইভিএমে কারচুপি করে ঢাকা সিটি নির্বাচনে বিএনপির জয় কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন দলটির দুই মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Feb 2020, 02:49 PM
Updated : 6 Feb 2020, 05:31 AM

গত ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যানের পর তার কারণ তুলে ধরে বুধবার দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে এসে পুনর্নির্বাচনের দাবি তোলেন ধানের শীষের এই দুই প্রার্থী।

নির্বাচন কমিশন ও সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের ডালি নিয়েই রাজধানীর দুই সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। ঢাকা উত্তরে মেয়র প্রার্থী হন তাবিথ আউয়াল ও দক্ষিণে মেয়র প্রার্থী হন ইশরাক। 

গোলযোগহীন ওই নির্বাচনে কেন্দ্রে ছিল ভোটারের খরা; ভোটগ্রহণ শেষে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করে চূড়ান্ত ফল ঘোষণার আগেই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি।

সেদিনই বিএনপি মহাসচিব ফখরুল বলেছিলেন, তারা নির্বাচনের সার্বিক চিত্র নিয়ে তথ্য উপাত্তসহ সংবাদ সম্মেলনে আসবেন। বুধবার গুলশানে ইমানুয়েল ব্যাংকুয়েট হলে দলের দুই প্রার্থীকে দুই পাশে বসিয়ে সেই সংবাদ সম্মেলনে আসেন তিনি।

তাবিথ বলেন, “সকল ঢাকাবাসী জানে, এটা ইলেকশন হয় নাই।”

“সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের দিন নগরবাসীর সাথে অন্যায় করা হয়েছে, তাদের হক কেড়ে নেওয়া হয়েছে,” বলেন ইশরাক।

এদিকে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. আলমগীর বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, গেজেট হয়ে যাওয়ায় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল বাতিলের আর কোনো সুযোগ নেই। এখন কেবল আদালত চাইলে তা করতে পারে।

‘কেন্দ্রে যেতে বাধা’

উত্তরে বিএনপির প্রার্থী তাবিথ বলেন, “আমাদের প্রতিপক্ষের মূল কৌশলই ছিল ভোটাররা যেন কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না পারে; আর পারলেও যেন কেন্দ্রের ভেতরে গিয়ে ভোট দিতে না পারে।

“বিভিন্ন কেন্দ্রে ফেইক লাইন করা হয়েছে। যাতে তারা কেন্দ্রে না যেতে পারে। ভেতরে কেন্দ্র খালি, কিন্তু বাইরে একই দলের একই কর্মী বাহিনী জড়ো হয়ে আছে, এরকম চিত্র দেখা গেছে বিভিন্ন জায়গায়।”

অন্য দলের সমর্থক ভোটারদেরও কেন্দ্রে যেতে ক্ষমতাসীনরা একই রকম বাধা দিয়েছে বলে বিএনপি প্রার্থীর অভিযোগ।

ইশরাক বলেন, “প্রচারণায় আমরা জনগণের ব্যাপক সাড়া পেয়েছি, ধানের শীষের পক্ষে একটি ব্যাপক গণজোয়ার সৃষ্টি করতে পেরেছিলাম। এগুলো দেখে ক্ষমতাসীনরা নানা কূটকৌশল প্রয়োগের চেষ্টা করেছে। নির্বাচনের দিন তারা ভোট কেন্দ্রগুলোতে সকাল সকাল দখল করার পাঁয়তারা করেছে। কেন্দ্র দখল করে চলে জাল ভোটের মহাৎসব।”

বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে গিয়ে পুলিশ, নির্বাচনী কর্মকর্তা এবং নির্বাচনে সহায়তাকারী অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের মধ্যে অসহায়ত্ব ও হতাশা দেখতে পেয়েছেন মন্তব্য করে ইশরাক বলেন, “তাদের কিছুই করার ছিল না। কারণ উপর থেকে নির্দেশ এসেছে। দেশের সকল রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয় আজ্ঞাবহ হতে বাধ্য করা হয়েছে।

“প্রিজাইডিং অফিসাররা অসহায় হয়ে আমাদের বলেছেন, তাদের কিছুই করার নাই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছেন একে অপরের দিকে।”

বিভিন্ন জায়গায় ধানের শীষের এজেন্টদের পিটিয়ে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয় বলে দাবি করেন বিএনপির প্রার্থীরা। পোলিং বুথে একাধিক ব্যক্তির অবস্থানের নানা প্রমাণও তুলে ধরেন তারা।

ইভিএমে কারচুপি’

তাবিথ বলেন, ”একটা উদাহরণ দিচ্ছি; লক্ষ্য করবেন, ১ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার সময়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মাত্র ৩১১টা কেন্দ্রের ফলাফল দিয়েছিল। ওই সময়ে দুই প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান ছিলো মাত্র ২৩ হাজার।

“তাহলে প্রশ্ন জাগে, কী করে রাত ৯টার সময়ে আমার প্রতিপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর ভবন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে বিজয়ী নিশ্চিত ঘোষণা করেন গণমাধ্যমের সামনে এবং বিজয় মিছিলও শুরু করে দেয়। তখন ২০ শতাংশের কম ফলাফল দেখা হয়েছিল। ভোর ৪টার সময়ে আনফিশিয়ালি তাকে এগিয়ে থাকার ঘোষণা দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন।”

ইভিএমে ফল ঘোষণায় দেরি নিয়ে তাবিথ বলেন, “ইভিএমের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, রেজাল্ট চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে দেওয়া যাবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাহেবও আমাদেরকে বলেছিলেন। রাত ৯টার মধ্যে জনগণের সামনে রেজাল্ট পেশ করা উচিৎ ছিল।

“ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মানুষদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ভোর ৪টা পর্যন্ত। তারপরেও আমরা মৌখিক রেজাল্ট পেয়েছি, এখনও লিখিত বা তথ্য সম্বলিত কোনো রেজাল্ট আমরা পাই নাই। বোঝা যাচ্ছে যে, এখানে চুরি করা হয়েছে, এখানে অনেক ভোট বদলানো হয়েছে । সেই কারণে ভোর ৪টা পর্যন্ত তাদের সময়টা লেগেছিল।”

ইভিএমের কনট্রোল ইউনিট থেকে রেজাল্টের তথ্য সরবরাহ না করা এবং ইভিএম ব্যবহারের আগে ফরম-৩ পূরণ না করারও অভিযোগ তোলেন তাবিথ।

ইভিএমে সংরক্ষিত সমস্ত তথ্য প্রকাশের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ”অবিলম্বে সমস্ত লগ প্রকাশ করা হোক। এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারব কনট্রোল ইউনিটে কী লেখা ছিল, রেজাল্ট শিটে কী এসেছে, ফাইনালি মৌখিক প্রকাশে কী রেজাল্ট আমরা পেয়েছি।

“আশা করি, নির্বাচন কমিশন নিজেদের স্বচ্ছতা প্রমাণ করার জন্য সমস্ত লগ পাবলিকলি রাইট ডেফিনেশন অ্যাক্টের আওতায় সবার জন্য ওপেন করে দেবে।”

ইশরাক বলেন, “ধীরে ধীরে ভোটার উপস্থিতি একেবারে কমে যাওয়াতে আমি মনে করি টোটাল কাস্ট ১০ শতাংশের অনেক কম হয়েছে। যার কারণে পরবর্তীতে বিশেষ কোড ব্যবহার করে প্রিজাইডিং অফিসারদেরকে ব্যালট ওপেন করে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়।

“তারপরেও ভোটগ্রহণ শেষে আমরা বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে রেজাল্ট সংগ্রহ করতে থাকি সেখানেও আমরা দেখতে পাই যে, ধানের শীষ এগিয়ে ছিলো। শিল্পকলা একাডেমি থেকে ভোটের ফলাফল ঘোষণা ৭টার পর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাত দেড়টায় দিকে নৌকাকে বিজয়ী করে সম্পূর্ণ একটা মনগড়া ফলাফল ঘোষণা করা হয়।”

ফলাফল বাতিল চান ফখরুল

ঢাকা সিটি নির্বাচনের ঘোষিত ফলাফল বাতিল করে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ।

তিনি বলেন, ”আজকে অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এই ধরনের একটি নির্বাচনে যেখানে প্রকৃতপক্ষে ৭ থেকে ৯ শতাংশে বেশি ভোট পড়েনি, সেখানে এই নির্বাচনে মধ্য দিয়ে যারা জয়ী হয়েছেন তাদের আসলে এখানে আইনগত কোনো যোগ্যতা থাকছে কি না জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সেই দায়িত্ব পালন করবার?

“আমরা খুব স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এই নির্বাচনে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি এবং এই নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। সুতরাং এই নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে দিয়ে নতুন করে নির্বাচনের আমরা আহ্বান জানাচ্ছি।”

সাংবাদিকদের উদ্দেশে ফখরুল বলেন, “নির্বাচনের যে প্রকৃত চিত্র তা আপনাদের সামনে আমাদের দুই মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল সাহেব ও ইশরাক হোসেন সাহেব তুলে ধরেছেন। আমরা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করেছি যে, এই সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের উপরে জনগণের কোনো আস্থা নেই।”

আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না বলেও মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বরকতউল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, আবদুস সালাম, আতাউর রহমান ঢালী, হাবিবুর রহমান হাবিব, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, শামা ওবায়েদ, সাখাওয়াত হোসেন জীবন, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আফরোজা আব্বাস, মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, শহীদুল ইসলাম বাবুল, আবদুল আউয়াল খান, সেলিমুজ্জামান সেলিম, শাহ আবু জাফর, আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম, সেলিম রেজা হাবিব, আবুল হোসেন, জেবা খান, সালাহউদ্দিন ভুঁইয়া শিশির, বজলুল বাসিত আনজু, আহসানউল্লাহ হাসান, আলী আকবর চুন্নু।

জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, এলডিপির একাংশের শাহাদাত হোসেন সেলিম এবং বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীরাও সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন।

স্থায়ী কমিটির বৈঠক

বুধবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটি বৈঠকে বসে। তবে বৈঠকের আলোচনা নিয়ে সাংবাদিকদের কোনো কথা বলেননি মহাসচিব ফখরুল।

তবে দলটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যশোর, বগুড়া ও ঢাকায় শূন্য আসনে  উপনির্বাচন ও খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয় এই বৈঠকে।

গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এই বৈঠকে লন্ডন থেকে স্কাইপে যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

বৈঠকে খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, আবদুল মটন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ছিলেন।