‘বড় স্বপ্ন’ নিয়ে মেয়র পদের লড়াইয়ে তাপস

ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ একটি আসন থেকে তৃতীয় মেয়াদে সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালন করছিলেন, সেই পদ ছেড়ে মেয়র হওয়ার লড়াইয়ে নামার পেছনে ঢাকার উন্নয়নের জন্য তাড়নার কথা বললেন শেখ ফজলে নূর তাপস।

মাসুম বিল্লাহও কাজী মোবারক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Jan 2020, 05:31 AM
Updated : 13 Jan 2020, 05:31 AM

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের এই মেয়র প্রার্থী বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের যে স্বপ্নের কথা বলছেন, তার সঙ্গে মিলে উন্নত রাজধানী গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে তার।

সে লক্ষ্যে ঢাকাবাসীর নাগরিক অধিকার নিশ্চিতে কাজের পাঁচটি ক্ষেত্রও চিহ্নিত করেছেন ফজলে নূর তাপস।

মশাবাহিত প্রাণঘাতী রোগ ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তারের বছর পেরিয়ে এই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে এবারও মনোনয়নের দৌড়ে ছিলেন মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, যার বাবা প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ হানিফ অবিভক্ত ঢাকার মেয়র ছিলেন।

ডেঙ্গুর মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েন খোকন। তার জায়গায় ঢাকার একাংশে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া তাপস বলছেন, নির্বাচিত হলে সিটি করপোরেশনের কাজে কোনো গাফিলতি হতে দেবেন না তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমরা দায়িত্বগ্রহণের প্রথম ৯০ দিনের মধ্যে মৌলিক নাগরিক সুবিধাগুলো জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে চাই। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঢাকাবাসী সকল নাগরিকের জন্য কাজ করে যাবে। আজকে কাজ হল, কালকে হল না- এমন না।”

সাংসদ থেকে মেয়রের প্রতিদ্বন্দ্বিতায়

সাক্ষাৎকারে সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আসার কারণও ব্যাখ্যা করেন ফজলে নূর তাপস।

তিনি বলেন, ”দেশ যে গতিতে এগিয়ে চলেছে, সে গতিতে ঢাকার উন্নতি হচ্ছে না। অনেকগুলো মৌলিক নাগরিক সুবিধা থেকে এখনও ঢাকাবাসী বঞ্চিত। এ সব বিষয় আমাকে খুব পীড়া দিয়েছে।

”আমি মনে করেছি, এখানে আরও বৃহত্তর পরিসরে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পনা অনুযায়ী যেভাবে দেশ এগিয়ে যাবে, তার সাথে সাথে রাজধানী ঢাকাও এগিয়ে যাবে।”

সংসদ সদস্য হলেও সিটি করপোরেশন এলাকায় নগর কর্তৃপক্ষের বাইরে উন্নয়ন করার সুযোগ সীমিত থাকাও মেয়র হতে চাওয়ার আরেকটি কারণ বলে জানান তাপস।

তিনি বলেন, “আমি তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছি সংসদ সদস্য হিসাবে। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদের পর থেকে আমি যখন আমার এলাকার উন্নয়নমূলক কাজগুলো আরম্ভ করেছি, পরিকল্পনা ও জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী করতে গিয়েছি, তখন আমি লক্ষ করেছি বা অনুভব করেছি- আমরা চাইলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কাজ করা হয়ে উঠে না।

”কারণ তা বহুলাংশে সিটি করপোরেশনের উপর নির্ভরশীল।”

তাপস বলেন, “আমি মনে করেছি, আমাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে তিনি মাত্র ১১ বছরের মধ্যে একটি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত করেছেন এবং আমাদেরকে এখন রূপকল্প দিয়েছেন বাংলাদেশকে ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ একটি উন্নত বাংলাদেশ হবে।

”সেখানে উন্নত বাংলাদেশের একটি উন্নত রাজধানী প্রয়োজন। সেটা হবে আমাদের উন্নত ঢাকা। সেই উন্নত ঢাকা আমরা এখনও করতে পারিনি।”

 

পাঁচ ভাগে উন্নয়ন পরিকল্পনা

পাঁচ ভাগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন পরিকল্পনা জানিয়ে সেগুলোর নাম প্রকাশ এবং ব্যাখ্যাও সাক্ষাৎকারে দিয়েছেন নৌকার প্রার্থী ফজলে নূর তাপস।

তিনি বলেন, এই পাঁচটি বিষয়ে প্রাধান্য দিয়ে প্রণীত হবে নির্বাচনী ইশতেহার। সেখানে বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে থাকবে।

ঐতিহ্যের ঢাকা: প্রথম ভাগ ’ঐতিহ্যের ঢাকা’র ব্যাখ্যায় তাপস বলেন, “আমাদের ঢাকা একটি পুরানো শহর, যেটা দুটি নদীর অববাহিকায় স্থাপিত, সে ঢাকার ঐতিহ্যকে আমরা পুনরুজ্জীবিত করব এবং ঢাকার স্বকীয়তাটাকে আমরা প্রস্ফুটিত করব, অপরূপটাকে প্রস্ফুটিত করব।”

সুন্দর ঢাকা: ’সুন্দর ঢাকা’ নামে দ্বিতীয় ভাগের আওতায় ঢাকার নাগরিক সুবিধাগুলো নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ফজলে নূর তাপস।

তিনি বলেন, “সবুজায়ন করব, প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত খেলাধুলার জায়গা আমরা দেব। যাতে করে আমাদের নতুন প্রজন্ম খেলাধুলা করতে পারে, আমাদের মা-বোনেরা এবং বয়স্করা হাঁটাহাঁটি করতে পারে। আমরা একটি আধুনিক নগরীর মতো করে ঢাকাকে গড়ে তুলব, যা হবে আমাদের সুন্দর ঢাকা।”

সচল ঢাকা: তৃতীয় ভাগ ’সচল ঢাকা’র ক্ষেত্রে গণপরিবহন ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করে নাগরিকদের পথচলা সহজ করার কথা বলছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী।

তিনি বলেন, “যেখানে আমাদের গণপরিবহনগুলোকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে, সমন্বয় করতে হবে এবং সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদের সব যাতায়াত ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, যার মাধ্যমে আমাদের নাগরিকদের কাছে সব সুবিধা থাকবে। সেটা মেট্রোরেল হোক, বাস সার্ভিস হোক, ট্যাক্সি হোক, রিকশা হোক, হেঁটে পথচলা হোক অথবা ঘোড়ার গাড়ি হোক।”

নাগরিকদের সুবিধামতো পৃথক যাতায়াত ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাপস বলেন, ”কিছু রাস্তায় মানুষ হেঁটে চলবে, কিছু রাস্তায় মানুষ ঘোড়ার গাড়িতে চলবে, কিছু রাস্তায় হয়তবা দ্রুতগতিতে যানবাহন চলবে, কিছু রাস্তায় ধীরগতির যানবাহন চলবে।

”এভাবে সমন্বিত-সামষ্টিক একটি ব্যবস্থাপনা থাকবে, যার মাধ্যমে আমরা ঢাকাকে, যেটা এখন অচল ঢাকা হয়ে গেছে, সেটা সচল হিসাবে গড়ে তুলব।”

সুশাসন:
উন্নয়ন পরিকল্পনার চতুর্থ ভাগে দুর্নীতিমুক্ত ও স্বায়ত্তশাসিত ঢাকা দক্ষিণ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাপস বলেন, “ঢাকা দক্ষিণ সিটিকে পরিপূর্ণভাবে একটি দুর্নীতিমুক্ত, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলব।

”আমরা আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াব এবং আমরা কারও কাছে দায়বদ্ধ থাকব না। ঢাকাবাসীর উন্নয়নের জন্য আমরা দায়বদ্ধ থাকব এবং অন্যান্য সকল সংস্থা যারা ঢাকাতে কাজ করে বা ঢাকাতে অবস্থিত তারা সিটি করপোরেশনের কাছ দায়বদ্ধ থাকবে।”

উন্নত ঢাকা: পরিকল্পনার পঞ্চম ভাগে ঢাকা দক্ষিণের উন্নয়নে ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা নেওয়ার কথা বলছেন ফজলে নূর তাপস।

তিনি বলেন, “আমরা পরিকল্পনা তৈরি করব ৩০ বছরের দীর্ঘমেয়াদি এবং সেখানে আমাদের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা যে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করব, সেটার অন্তত ১০ বছরের স্থায়িত্ব হবে। সেভাবে আমরা মানটি নিরূপণ করব।”

উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নগর প্রশাসনের বাইরে অন্যদের সঙ্গে সমন্বয়ের একটি পরিকল্পনাও সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী।

তিনি বলেন, “অন্যান্য সংস্থা যারা ঢাকায় কাজ করবে, আমাদের কাজ করার পরে অন্ততপক্ষে তিন বছর কোনো কাটাকাটি, খোঁড়াখুঁড়ি বা অন্য কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে না।

”আমরা সেভাবে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে তাদের যে জায়গাটায় কাজ করার কথা, সেই জায়গাগুলো খালি রেখে আমাদের অন্যান্য জায়গায় কাজগুলো করব। তাদের কাজ হয়ে গেলে আমরা কাজ করলাম। তখন আবার অন্য সংস্থা এসে সেখানে কাজ করতে পারবে। অন্ততপক্ষে তিন বছর কাজ করতে পারবে না।”

তাপস বলেন, “আমি মনে করি যে, এটাতে অব্যবস্থাপনায় অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে, জনগণ তাদের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এটা আমরা আর বরদাশত করব না।”

ডেমরার আমুলিয়া মডেল টাউনে শুক্রবার নির্বাচনী প্রচারে ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস। ছবি: মাহমুদ জামান অভি

ইভিএম প্রশ্নে

ইভিএমে ভোটগ্রহণ নিয়ে শঙ্কার কথা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন তাপসের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন।

তবে নৌকার প্রার্থী তাপস বলছেন, ইভিএম সহজ ও আধুনিক পদ্ধতি। এটা নিয়ে বিএনপির বক্তব্য ’রাজনৈতিক ফায়দার’ জন্য।

তিনি বলেন, ”ইভিএম একটি নতুন আধুনিক পদ্ধতি ভোট দেওয়ার, আমারও জানা ছিল না। আমি কিছু দিন আগেই নির্বাচন কমিশন যে অডিও-ভিজুয়াল তৈরি করেছে সেখান থেকে দেখলাম, খুবই সহজ একটি পদ্ধতি মনে হয়েছে। আমি মনে করি, জনগণ সেভাবে গ্রহণ করেছে এরই মাঝে।

“এটি একটি আধুনিক প্রযুক্তি। আমরা সব সময় প্রযুক্তি ও আধুনিকতাকে পছন্দ করি। আমার মনে হয়, জনগণের এ ব্যাপারে কোনো শঙ্কা নেই। এটা শুধুমাত্র একটা রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার জন্য কথাগুলো বলা হচ্ছে।”

নির্বাচনী পরিবেশ প্রসঙ্গে

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে নিজের সুবিধার জন্য বিরোধীদের হয়রানি করবে বলে শঙ্কার কথা বলছে বিএনপি।

এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বলেন, “জাতীয় রাজনীতির কূটকৌশল নিয়ে আমি চিন্তিত না। আমি চিন্তিত আমার যে পরিকল্পনা সেটা জনগণের কাছে তুলে ধরা, ঢাকাবাসীর কাছে তুলে ধরা এবং প্রচারে অংশগ্রহণ করা।

”ঢাকাবাসীর মধ্যে একটা স্বতঃস্ফুর্ততা উপলব্ধি করছি এবং তারা উন্মুখ হয়ে আছে আগামী ৩০ জানুয়ারি ভোট দিয়ে তাদের একজন সেবক তারা নির্বাচিত করবেন। যে সেবক সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে তাদের জন্য পরিপূর্ণভাবে কাজ করতে পারবে।”

ব্যারিস্টার তাপস বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির ছোট ছেলে। যুক্তরাজ্যে লেখাপড়া করে আসা তাপস প্রায় দুই দশক আইন পেশায় আছেন। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদেরও নেতৃত্বে আছেন তিনি।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েই জয় পান তাপস। এরপর টানা দুই দফায় ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য হন তিনি। তার বড় ভাই শেখ ফজলে শামস পরশ গত নভেম্বরে যুবলীগের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।