ক্যাসিনোকাণ্ডের ধাক্কা মনোনয়নেও: মোট বাদ ৫৫ কাউন্সিলর

ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে শুদ্ধি অভিযানে এই বছরে আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্বে পরিবর্তনের সঙ্গে ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে দলীয় প্রার্থীও পরিবর্তন হয়েছে।

ওবায়দুর মাসুম জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Jan 2020, 11:15 AM
Updated : 8 Jan 2020, 01:47 PM

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে বর্তমান ১৭২ জন কাউন্সিলরের মধ্যে এবার ৫৫ জন দলের সমর্থন পাননি। এদের মধ্যে ৩৬ জনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর, যাদের অনেকের বিরুদ্ধে ক্যাসিনোকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতাসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১৯ জন এবং উত্তরে ১৭ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে প্রার্থী পরিবর্তন করেছে আওয়ামী লীগ।

গত ২৯ ডিসেম্বর ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়র মনোনয়নের পাশাপাশি কাউন্সিলর পদে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়।

ওই দিন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, “জনগণের কাছে প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। কোন প্রার্থী নির্বাচনে জেতার উপযোগী, সেটি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।”

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭৫ জন সাধারণ, ২৫ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর এবং উত্তর সিটি করপোরেশনে ৫৪ জন সাধারণ এবং ১৮ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর।

দক্ষিণে সিটিতে সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর আছেন আওয়ামী লীগের ৬৬ জন ও বিএনপির ১০ জন। সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরদের মধ্যে ২০ জন আওয়ামী লীগ এবং পাঁচজন বিএনপি সমর্থিত।

এই সিটিতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলরদের মধ্যে দুজন দলের মহানগর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন, মারা গেছেন একজন। বাকি ৬৩ জনের মধ্যে ৪৪ জন মনোনয়ন পেয়েছেন, মনোনয়ন পাননি ১৯ জন। বিএনপির ১০ জনের মধ্যে আটজন মনোনয়ন পেয়েছেন, একজন কাউন্সিলর নির্বাচনে আসেননি। বাদ পড়েছেন একজন।

দক্ষিণে আওয়ামী লীগের ২০ নারী কাউন্সিলরের মধ্যে ১০ জন মনোনয়ন পেয়েছেন, একজন সাধারণ কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন পেয়েছেন, আর বাদ পড়েছেন নয়জন। বিএনপির নারী কাউন্সিলরদের সবাই এবারও দলের মনোনয়ন পেয়েছেন।

ঢাকা উত্তরের ৫৪ জন কাউন্সিলরের মধ্যে একজন বিএনপি ও একজন জাতীয় পার্টির। মনোনয়ন পেয়েছেন ৩৫ জন, ১৭ কাউন্সিলর মনোনয়ন পাননি, যাদের সবাই আওয়ামী লীগের।

এই সিটির ১৮ জন নারী কাউন্সিলরের মধ্যে তিনজন বিএনপির, বাকি ১৫ জন আওয়ামী লীগের। ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত একজন সাধারণ কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন পেয়েছেন। আর বাকি ১৪ জনের মধ্যে মনোনয়ন পেয়েছেন পাঁচজন, বাদ পড়েছেন নয়জন।

দক্ষিণের ১, ৮, ৯, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২১, ২২, ৩২, ৩৯, ৫০, ৬০, ৬৩, ৬৭ ও ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবার মনোনয়ন পাননি। আর উত্তরের ৩, ৬, ৭, ৮, ১২, ১৪, ১৭, ২০, ২৩, ২৫, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৪২, ৪৩, ৪৮ ও ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরকে এবার মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।

ক্যাসিনোকাণ্ডে আলোচিত হওয়ার পর ঢাকা দক্ষিণের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদ থেকে বরখাস্ত হন একেএম মমিনুল হক সাঈদ। সেপ্টেম্বরে ওই অভিযানের সময় চিকিৎসার জন্য বিদেশে ছিলেন ক্যাসিনো সাঈদ হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিলর। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দেশে ফিরে আসেন সাঈদ। তবে এবার আর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি তিনি। তার জায়গায় ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মোজাম্মেল হককে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।

দলীয় মনোনয়ন না পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন সাঈদ। তার স্ত্রীও একই পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।

ঢাকা দক্ষিণের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর মোস্তবা জামান পপির জায়গায় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে পল্টন থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. এনামুল হককে।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় ঢাকা উত্তরের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইকবাল হোসেন তিতুর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ বিভিন্ন অভিযোগ অনুসন্ধানে মাঠে নামে দুদক। সে সময় কিছু দিন দেশের বাইরে ছিলেন তিতু। তার জায়গায় ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মুরাদ হোসেনকে প্রার্থী করেছে আওয়ামী লীগ।

 অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে মিরপুরের শাহ আলী এলাকার তিতু বলছেন, ‘ষড়যন্ত্রের কারণে’ এবার দল থেকে মনোনয়ন পাননি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এ কাজে ‘কিছু সাংবাদিককেও ব্যবহার করেছে’।

“এরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমার বিরুদ্ধে লেখাইছে। আমি আওয়ামী লীগের বিপদের দিনের কর্মী। প্রথমে আমাকেই দিয়েছিল। পরে আমাকে কেটে মুরাদ ভাইকে দিয়েছে।”

ঢাকা উত্তরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মোবাশ্বের চৌধুরী স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা কায়সারের ভগ্নিপতি। ক্যাসিনোকাণ্ডে নাম আসার পর দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় মোল্লা কায়সারকে। তার নির্বাচনী এলাকা মিরপুরের রূপনগরে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি তোফাজ্জল হোসেনকে।

তবে মোবাশ্বের চৌধুরী বলছেন, তিনি নিজেই এবার নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাননি।

“আমি গত দুই মাস আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, নির্বাচন করব না। কারণ এখন আর মানসম্মান নিয়ে চলা যায় না।”

শুদ্ধি অভিযানের মধ্যে অক্টোবরের প্রথমার্ধে ঢাকা উত্তরের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজানকে শ্রীমঙ্গল থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। পাগলা মিজান হিসেবে পরিচিত এই কাউন্সিলর মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে হত্যা, মাদকের কারবার, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। দুদকের মামলায় এখন কারাবন্দি মোহাম্মদপুরের এই কাউন্সিলর। তার জায়গায় মনোনয়ন পেয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ হাসান নূর ইসলাম।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মোহাম্মদপুরের আরেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিব। ১৯ অক্টোবর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ও মদসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে তিনিও কারাবন্দি। তার এলাকা ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সদস্য আসিফ আহমেদ।

উত্তরের ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আবু তাহের খান মারা যান গত বছরের ২৩ জুন। সেখানে উপনির্বাচন হয়নি। ওই ওয়ার্ডে মনোনয়ন পেয়েছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ হোসেন।

দুই সিটিতে এবার দুজন নারীকে কাউন্সিলর (সাধারণ) পদে প্রার্থী করা হয়েছে। তারা হলেন- উত্তর সিটির ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আলেয়া সারোয়ার (ডেইজি)। আর দক্ষিণে ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে মনোনয়ন পেয়েছেন হেলেন আক্তার, যিনি ৪৫, ৪৬, ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত সংরক্ষিত নারী-১৭ আসনের কাউন্সিলর।

এছাড়া দক্ষিণের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবু আহমেদ মন্নাফী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছেন। সেখানে তার ছেলে আহমদ ইমতিয়াজ মন্নাফী মনোনয়ন পেয়েছেন।

আর ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. হুমায়ুন কবির ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। এই ওয়ার্ডে তার ভাই মকবুল হোসেনকে সমর্থন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।