‘নাতি বয়সী’ ছাত্রদলে আশার আলো দেখছেন ফখরুল

ছাত্রদলে এবার তরুণদের সমাবেশ দেখে অনুপ্রাণিত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্ররাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, এই ‘টগবগে মুখগুলো’ আশার আলো হয়ে এসেছে তাদের সামনে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Jan 2020, 12:48 PM
Updated : 1 Jan 2020, 01:09 PM

বুধবার ঢাকার রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয়তাবাদী ছাত্র দলের ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, “আজকে এখানে এসে আমার মনটা ভরে গেছে। কিছু দিন আগেও আমি দেখেছি, ছাত্রদলের সেই মুখগুলো বরাবর চেনা মুখ, একটু বয়স্ক বয়স্ক মুখ। আজকে আমি দেখছি তরুণ, টগবগে মুখ সব, যা আমাকে এবং আমাদের সবাইকে নতুন আশার আলো দেখিয়েছে বন্ধুগণ। তোমাদের বন্ধু বলছি, তুমি বলছি এজন্য যে, তোমারা আমার একেবারে নাতি বয়সী প্রায়।”

নিজের বয়স হওয়ার প্রমাণ তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “১৯৬৩ সালে আমি ঢাকা কলেজে পড়েছি। ১৯৭৪ সালে আমি ঢাকা কলেজে পড়িয়েছি, শিক্ষক ছিলাম (অর্থনীতি বিভাগ)। এখন বয়স ৭০- এর উপরে। আমাদের কী বলা হয়, ৭০ অন্তত বৃদ্ধ। এখন বয়স বেড়েছে বলা হয়- সত্তরোত্তর বৃদ্ধ, সেই বৃদ্ধ আমরা। আমরা তোমাদেরকে কথা বলতে পারি, আমরা তোমাদেরকে পথের দিশা দেখাতে পারি কিন্তু সেই পথের সামনের সারির পথিকৃত কারা হবে? তোমরা। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ভ্যানগার্ডস। সেই ভ্যানগার্ড হতে হবে তোমাদেরকে, সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে তোমাদেরকেই, যাদের কোনো পিছুটান থাকবে না।”

সভায় উপস্থিত ছাত্রদল নেতাকর্মীরা

ছাত্রদের উজ্জীবিত করতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আমাদের বিখ্যাত বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘কে আছো জোয়ান হও আগুয়ান, হাকিছে ভবিষ্যৎ’। তোমাদের দিকে তাকিয়ে গোটা বাংলাদেশ, তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে গোটা দেশের ১৬ কোটি মানুষ, তোমাদের দিকে তাকিয়ে আছে আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ওই জেলখানার মধ্য থেকে আর দূরে হাজার মাইল দূরে আমাদের তারেক রহমান।

“আশান্বিত- অনেকদিন পরে তরুণদের নির্বাচিত একটা ছাত্রদল গঠিত হয়েছে, তার কার্য্করী পরিষদ গঠিত হয়েছে। তারা আজকে চমৎকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান করছ তোমরা। আমরা এখানে যারা আছি- সবাই আশার আলো দেখতে পারছি।স্বপ্ন আমাদের দেখতে হবে। সেই স্বপ্ন হচ্ছে আমাদের এই বাংলাদেশ একটা সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চাই। আমরা এই অন্ধকার, যন্ত্রণাময়, মানুষকে অন্যায়-অত্যাচার করে হত্যা করা, নির্যাতন করা, আমার ছেলেদের গুলি করে মারা, তাদের হাঁটুতে গুলি করে মারা, তাদের গুম করে দেওয়া-এই বাংলাদেশ আমরা আর দেখতে চাই না।”

আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে তরুণ শিক্ষার্থীরা থাকলেও এতদিন ছাত্রদলের নেতৃত্বে ছিলেন অপেক্ষাকৃত বয়সীরা। গত সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত ছাত্রদলের কাউন্সিলে প্রথমবারের মতো নেতৃত্বের জন্য বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া হয়, ২০০০ সালের আগে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীরা পদ প্রত্যাশীদের তালিকা থেকে বাদ পড়ে যান।

২৭ বছর পর গত ১৯ সেপ্টেম্বর কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে ফজলুর রহমান খোকন ছাত্রদলের সভাপতি এবং ইকবাল হোসেন শ্যামল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।এর তিন মাস পরে ৬০ সদস্যের আংশিক কমিটি দেয় ছাত্রদল।

রাজনীতিতে বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে নেতৃত্বের জন্য ২৭ বছরের বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া রয়েছে। তবে বয়সের বিষয়টিতে তারা প্রথম কড়াকড়ি দেখায় ২০০৬ সালে, সম্মেলন নির্ধারিত সময়ের দেরিতে হওয়ায় দুই বছর বয়স বাড়িয়ে অনূর্ধ্ব ২৯ বছর বয়সীদের নেতা হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।

এরপর থেকে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্রদের দেখা গেলেও ছাত্রদলের নেতৃত্বে ছিলেন তাদের কয়েক বছরের বড়রা। নিয়মিত ছাত্র না হওয়ায় ক্যাম্পাসে অবাধ বিচরণ ও সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোর সুযোগ চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তেমন সাড়া পেতেন না তারা।

এবার সেই বাধা উঠে যাওয়ায় আশাবাদী মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “ভারত আইন করেছে, যে আইন একটা বৈষম্যমূলক আইন, যে আইনের মধ্যে ধর্মীয় বৈষম্য রয়েছে। সেই আইনের বিরুদ্ধে ভারতে আজকে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে। কারা প্রথম বেরিয়েছে? ছাত্ররা। আজকে গোটা ভারতবর্ষে সমস্ত ছাত্ররা তাদের সেই আইনের বিরুদ্ধে নেমে পড়েছে।আজকে হংকংয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হচ্ছে, কারা করছে- ছাত্ররা করছে।

“এদেশে কোনো কিছুই সম্ভব হয় নাই ছাত্রদের অগ্রণী ভূমিকা ছাড়া। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছিল, আমানউল্লাহ আমান সাহেবরা নির্বাচিত হয়েছিলেন সবাই। কীভাবে? নব্বইয়ের আন্দোলনের পর সব ছাত্র নেতারা চলে গিয়েছিলেন গ্রামে-গঞ্জে, গিয়ে সমস্ত মানুষকে সংগঠিত করে ধানের শীষে ভোট দিয়েছিল বলেই বিএনপি জিতেছে।”

বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আজকে মেয়র ইলেকশন হচ্ছে। আমি খুব খুশি হতাম যদি মেয়র প্রার্থী দুইজন এখানে আসতেন, এসে তোমাদের সাথে পরিচিত হতেন। তোমরা ছড়িয়ে পড়ো ঢাকা শহরে। প্রতিটি গলিতে গলিতে, বাড়িতে বাড়িতে যাও এবং বলো যে, আজকে শুধু পরিবর্তনের জন্যে আমাদেরকে ধানের শীষে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করতে হবে এজন্য যে, আমরা পরিবর্তন আনতে চাই। আজকে গোটা দেশের মানুষ পরিবর্তন চায়।”

ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের তিনি বলেন, “এসো আমরা সবাই জেগে উঠি, ঐক্যবদ্ধ হই এবং আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে বাঁচাবার জন্য আমরা পরিবর্তন নিয়ে এসে বাংলাদেশকে রক্ষা করি- এই হোক আমাদের আজকের দিনের শপথ। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, গণতন্ত্রের মুক্তি এবং আমাদের সকলের মুক্তি।”

ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন, প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংগঠন গড়ে তোলা এবং ছাত্রদের সমস্যাগুলো সামনে নিয়ে আসতে কাজ করার জন্য ছাত্রদলকে পরামর্শ দেন বিএনপি মহাসচিব।

তিনি বলেন, “আজকে ডাকসুর ভিপি নূরকে (নুরুল হক নূর) যখন মারে, তাকে যখন শুইয়ে দেয়, তোমাদেরকে (ছাত্রদলের নেতা-কর্মী) যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিগৃহীত করে, তোমাদেরকে যখন আঘাত করে তখন তোমাদের জেগে উঠতে হবে, প্রতিরোধ করে দাঁড়াতে হবে। প্রতিরোধ ছাড়া বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয় না। এই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।”

বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আজকে বিএনপির প্রয়োজনে নয়, আজকে শুধু বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়োজনে নয়, আজকে শুধু তারেক রহমান সাহেবের প্রয়োজনে নয়, বাংলাদেশের মানুষের প্রয়োজনে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রয়োজনে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রয়োজনে আজকে আমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে, ছাত্রদের উঠে দাঁড়াতে হবে, গোটা বাংলাদেশের মানুষকে জেগে উঠতে হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে রক্ষা করবার জন্য।”

এই শীতের মধ্যে কারাবন্দি খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে রুম হিটার দিতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন ফখরুল।

তিনি বলেন, “দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ছাত্রদলের এই জন্মদিনে এই চেয়ারে বসতেন। আজকে তিনি অন্ধকারে, কারাগারে, শীতের মধ্যে অত্যন্ত কষ্টে আছেন। আমি গতকালই খবর পেয়েছি, তার রুমে একটা হিটার দেওয়ার জন্য নিয়ে গিয়েছিল, রুম হিটার। এই ভয়ঙ্কর নির্মম এই সরকার সেই হিটারটা পর্যন্ত অ্যালাউ করেনি।”

দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ড নিয়ে গত বছর ফেব্রুয়ারি থেকে কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত এপ্রিল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি।

প্রয়াত সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের তত্ত্বাবধানে ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৯ সালে ১ জানুয়ারি ছাত্রদল গঠিত হয়।

এদিন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা চলাকালে আসনে বসা নিয়ে ছাত্রদলের দুই পক্ষ মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন। পরে নেতারা গিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনেন।

এদিকে আলোচনা সভা শুরুর পরেও কর্মীরা অনবরত করতালি দিতে থাকলে এক পর্যায়ে বিএনপি মহাসচিবকে মাইক নিয়ে তাদের শান্ত করতে দেখা যায়।

তিনি বলেন, “যারা বক্তব্য দিচ্ছেন তাদের বক্তৃতা তোমরা শুনছ না। শুধু শ্লোগান দিলে চলবে না, নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শুনতে হবে। নিয়ম মেনে চলো, চুপ করে বক্তৃতা শোন।”

এরপর আলোচনা সভার পরিবেশ শান্ত হয়।এর আগে বেলা সোয়া ১২টার দিকে অনুষ্ঠানস্থল ইনস্টিটিউটের ফটকের সামনে দুটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটে।

ছাত্রদলের সভাপতি ফজলুর রহমান খোকনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন শ্যামলের পরিচালনায় আলোচনা সভায় ছাত্রদলের সাবেক নেতা শামসুজ্জামান দুদু, আসাদুজ্জামান রিপন, আমান উল্লাহ আমান, ফজলুল হক মিলন, নাজিম উদ্দিন আলম, কামরুজ্জামান রতন শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, এবিএম মোশাররফ হোসেন, আজিজুল বারী হেলাল, শফিউল বারী বাবু, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, আমিরুল ইসলাম খান আলীম, আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল, রাজীব আহসান, আকরামুল হাসান, ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবন, সহ-সভাপতি মুক্তাদির হোসেন তরু, মিজানুর রহমান শরীফসহ ঢাকা পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, তীতুমীর কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, বাংলা কলেজ, কবি নজরুল কলেজ শাখা ছাত্রদলের নেতারা বক্তব্য রাখেন।

অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুসহ সাবেক ছাত্রদল নেতারা উপস্থিত ছিলেন।