দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি রুখতে ছাত্রদের ভূমিকা চান সাবেক ছাত্রনেতারা

দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের অগ্রণী ভূমিকা দেখতে চাইছেন ডাকসুর সাবেক নেতারা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Dec 2019, 05:19 PM
Updated : 2 Dec 2019, 05:35 PM

ছাত্র রাজনীতি নিয়ে সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় সাবেক এই ছাত্রনেতারা তাদের প্রত্যাশার কথা জানান, যাদের সবাই বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে রয়েছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক এই আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ পড়ে শোনান নাগরিক সংগঠনটির নেতা দীলিপ সরকার।

এতে লেজুড়বৃত্তি ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি, ভর্তি বাণিজ্য-সিট বাণিজ্য কঠোরভাবে দমন, রাজনৈতিক বিবেচনায় উপাচার্যসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগের সংস্কৃতি পরিবর্তন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করাসহ ১০ দফা করণীয় তুলে ধরা হয়।

এই আলোচনায় উপস্থিতদের মধ্যে ডাকসুর জ্যেষ্ঠতম সাবেক ভিপি ও বর্তমানে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, জাতীয় রাজনীতি কলুষিত হলে তা কলুষমুক্ত করার সুযোগ ছাত্রদেরই থাকে।

গত শতকের ষাটের দশকে নিজের ছাত্র আন্দোলনের সময়ের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “এনএসএফ বা মোনায়েম খানের বা আইয়ুব খানের সেই কলুষিত রাজনীতিকেই কিন্তু আমাদের ছাত্র রাজনীতি পরাজিত করেছে, এরশাদের কলুষিত রাজনীতিকে আমরা ছাত্র আন্দোলন দিয়ে পরাজিত করেছি।

“জাতীয় রাজনীতি কলুষিত, সেজন্য ছাত্র আন্দোলনও দুর্বৃত্তায়িত হবে- এই যুক্তি ধোপে টেকে না। তারুণ্যকে তার প্রতিবাদের জায়গা থেকে, তার প্রতিরোধের জায়গা থেকে সংগঠিত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।”

তবে তার সঙ্গে ভিন্নমত জানান ১৯৭০-৭১ সালে ডাকসুর ভিপি ও বর্তমানে জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব।

তিনি বলেন, “জাতীয় রাজনীতি যদি সঠিকভাবে না থাকে, ছাত্র রাজনীতিও থাকবে না।”

ছাত্র রাজনীতি বন্ধের বিরোধিতা করে রব বলেন, “ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে চায় পাপ আড়াল করার জন্য। ছাত্ররা আসল কথা বলে দেয়। ছাত্রদের কোনো ভয় নাই। ধানের দাম পায় না, বিদ্যুতের দাম বাড়ে, তাদের (ছাত্রদের) বাবারা কথা বলতে পারে না। সচেতন সন্তানেরা কথা বলে তাদের মা-বাবার পক্ষে, জনগণের পক্ষে।

“সেজন্য ছাত্রদের কথা বলা বন্ধ করতে হবে। মানে ক্ষমতাসীন সরকারের যত পাপ আছে সেগুলো আড়াল করার জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার একটা পরিকল্পনা চলছে। তবে যারাই ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে চেয়েছে, তাদেরকে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে ক্ষমতা থেকে বিদায় হতে হয়েছে।”

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে রব বলেন, “একটা নমরুদের শাসন ব্যবস্থা দেশে চালু হয়েছে। এজন্য একমাত্র ছাত্রদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। ছাত্র রাজনীতি রাখার জন্য এই স্বৈরাচারী সরকারকে বিদায় করতে হবে।”

স্বাধীন বাংলাদেশে ডাকসুর প্রথম ভিপি ও বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “আমি মনে করি, ছাত্র রাজনীতির কৃষ্ণপক্ষ চলছে। কিন্তু সব কিছু হারিয়ে গেছে, এটা আমি মনে করি না। তাহলে গণজাগরণ মঞ্চ হতে পারত না, নিরাপদ সড়কের আন্দোলন হতে পারতো না, কোটা সংস্কারের আন্দোলন হতে পারত না, যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে পহেলা বৈশাখে যে আন্দোলন হয়েছে সেটা হতে পারত না।”

ছাত্র রাজনীতি বন্ধ না করে তা আরও অবারিত করে দেওয়ার উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “ছাত্র রাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতি এই দুটোর ভেতরে চীনের প্রাচীর তুলে কেউ কেউ নানারকম বক্তব্য দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

“একটা তর্ক আছে, কোনটা কজ আর কোনটা এফেক্ট। রুগ্ন রাজনীতির জন্য ছাত্র রাজনীতি খারাপ হচ্ছে, না রুগ্ন ছাত্র রাজনীতির জন্য জাতীয় রাজনীতি খারাপ হচ্ছে। আমি মনে করি দুটোই কজ, দুটোই এফেক্ট।

“রাজনীতি হল অর্থনীতির ঘনীভূত প্রকাশ। যতদিন আমাদের এখানে লুটপাটের অর্থনীতি বজায় থাকবে, আপনি সুস্থ ধারার রাজনীতিও পাবেন না, সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতিও পাবেন না।”

সেলিম ডাকসুর সাবেক নেতাদের নিয়ে একটি ফোরাম গঠনের প্রস্তাব দেন, যার নাম হবে ‘কাউন্সিল অব এক্স ভিপি-জিএস অব ডাকসু’।

এর কাজের ধরন বর্ণনা করে তিনি বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বের ইস্যুতে যে আন্দোলন, সেই আন্দোলনকে মনিটর করার জন্য এবং সেখানে একটা সঠিক ডাইরেকশনে নিয়ে যাওয়া।”

লেজুড়বৃত্তিমুক্ত ছাত্র রাজনীতি কী, তা স্পষ্ট করার উপর জোর দেন ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে দুই মেয়াদে ডাকসুর ভিপি ও বর্তমানে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না।

তিনি বলেন, “বেগম জিয়াকে যেরকম করে জেলে রাখা হয়েছে, সেটাকে আমি অন্যায় মনে করি। এখন কোনো ছাত্র এই অন্যায় মনে করে কোনো কথা বলতে পারেন। এটা কি বিএনপির লেজুড়বৃত্তি হবে? একটা দখলবাজ সরকার ক্ষমতায়, এর বিরুদ্ধে মিছিল করলে এটা কি লেজুড়বৃত্তি?

“মূল কথা হচ্ছে, সত্যের পক্ষে তারুণ্যের অবস্থান থাকতে হবে। আমরা ছাত্রদের কাছে সেটাই আশা করি। এদেশের গণতন্ত্রের আন্দোলনের ভ্যানগার্ড হচ্ছে ছাত্ররা।”

১৯৯০-৯১ সালে ডাকসুর ভিপি ও বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমানউল্লাহ আমান বলেন, “বর্তমান গণতন্ত্রহীন দেশের প্রেক্ষাপটে আমি বলব, একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তন প্রয়োজন। ডাকসুর ভিপিকে (নুরুল হক নুর) আমি বলব, তুমি নেতৃত্ব দাও, তোমার পাশে বুদ্ধিজীবীরা থাকবেন, আমরা সাবেক ছাত্রনেতারা থাকবো, তোমাকে সবাই সহযোগিতা করব।”

ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য রিয়াজুল কবির কাউসার বলেন, বর্তমান সরকার আমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে।

“গত ১০ বছরে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জট হয়েছে? হয়নি, ছাত্ররা যথাসময়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আমরা মনে করি, গত তিন দশকে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থা ভালো চলছে, ছোট খাটো সমস্যা থাকতে পারে।”

তিনি বলেন, “শিক্ষক রাজনীতি বর্তমানে একটা সমস্যা। দুধের মধ্যে পানি থাকবে, তবে পানি যেন দুধের চেয়ে বেশি না হয়ে যায়।”

ডাকসুর বর্তমান ভিপি নুরুল হক নুর বলেন, “আজকে প্রত্যেকটা অভিভাবক ছেলেকে বোঝান যে, বাবা তুমি রাজনীতিতে জড়িত হয়ো না। কিন্তু রাজনীতি খারাপ জিনিস না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যদি রাজনীতিতে যুক্ত না হয়, তাহলে এদেশ কিভাবে এগোবে?

“শিক্ষিত ছাত্ররা যদি রাজনীতিতে না আসে, তাহলে কি কাপড় ব্যবসায়ী কিংবা মাছ ব্যবসায়ী, কনট্রাকশন ব্যবসায়ী তারা আসবে?”

তিনি বলেন, “ছাত্র রাজনীতির নামে যে অপরাজনীতি করে সেটা কিন্ত সবাই না, গুটিকয়েক ছাত্র সংগঠন। আমি যদি বিগত ২০ বা ৩০ বছরের রেফারেন্সে যাই, সেখানে দেখবেন যে, দুটি দলের নাম সবচেয়ে বেশি আলোচনায় উঠে আসবে। সেটা হচ্ছে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল। এবং ইসলামিক ছাত্র শিবিরেরও কিছুটা নাম চলে আসে।”

সুজনের নির্বাহী সদস্য সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের সভাপতিত্বে ও সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় এই আলোচনায় সাংবাদিক অজয় দাশ ও আবু সাঈদ খান, কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, রাকসুর সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের নেতা আবু সাইয়িদ, জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নাজমুল হক প্রধান, ডাকসুর সাবেক এজিএস ও বিএনপি নেতা নাজিম উদ্দিন আলম, ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি রুহিন হোসেন প্রিন্স ও শরীফুজ্জামান শরীফও বক্তব্য রাখেন।