যুক্তরাষ্ট্র থেকে লাশ ঢাকায় আনার পর বৃহস্পতিবার সংসদ ভবন প্রাঙ্গণ, নয়া পল্টনের বিএনপির কার্যালয়, নগর ভবনসহ ছয়টি স্থানে জানাজার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হয় সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন।
এরপর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয় খোকাকে। এই কবরস্থানে তার মা সালেহা খাতুন ও বাবা এম এ করীমের কবর রয়েছে।
একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা খোকার মরদেহ কবরে নামানোর আগে রাষ্ট্রীয় সালাম জানায় পুলিশের ১৭ সদস্যের একটি দল, ঢাকা জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার আবদুল আউয়ালের নেতৃত্বে। তারা এই মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দেয়। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে আবদুল্লাহ আল নোমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারাও জানান ‘স্যালুট’।
দাফনের সময় পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিবউন নবী খান সোহেল।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান খোকা ক্যান্সার নিয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত সোমবার মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। পাঁচ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন তিনি, এর মধ্যে দুর্নীতির কয়েকটি মামলায় তার দণ্ড হয়েছিল। তার পাসপোর্টের মেয়াদও গিয়েছিল ফুরিয়ে।
তবে তার মৃত্যুর পর জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন নিউ ইয়র্ক কনস্যুলেটের প্রতিনিধি; লাশ দেশে আনার বিষয়ে সরকারও করেছিল সহযোগিতা।
খোকার কফিন বৃহস্পতিবার বিমানে ঢাকায় আনার পর প্রথমে নেওয়া হয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা। সাবেক এই সংসসদ সদস্যের জানাজায় সেখানে অংশ নেন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, এলডিপির নেতারা।
সেখান থেকে কফিন নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। বেলা ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পাশাপাশি অনেকে ব্যক্তিগতভাবে তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
পরে খোকার মরদেহ নেওয়া হয় তার দলীয় কার্যালয়ের সামনে। সেখানে শ্রদ্ধা জানানোর পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সদর দপ্তর নগর ভবনে নেওয়া হয় অবিভক্ত ঢাকার সর্বশেষ মেয়রের মরদেহ।
জুরাইনে দাফরে আগে গোপীবাগের ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাব প্রাঙ্গণ ও পুরান ঢাকার বালুর মাঠেও হয় খোকার জানাজা।
খোকা তিন মেয়াদে সংসদ সদস্য ছিলেন। খালেদা জিয়ার সরকারে দুই মেয়াদে মন্ত্রী ছিলেন তিনি। ২০০২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত ঢাকার নির্বাচিত মেয়র ছিলেন তিনি।
‘বাবা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার’
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন দাবি করেন, তার বাবা ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার’ হয়েছেন।
“আজকে আমরা ভুক্তভোগী। আমার বাবা রাজনীতির প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। গত পাঁচ বছরে আমি বাবার সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। তার থেকে আমি অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। তিনি সব সময় আমাদের বলতেন, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল একটি গণতন্ত্র রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু আজকে আমরা যেটা দেখছি একটি হানাহানির রাজনীতি চলছে দেশে। এই রাজনীতির জন্য আমার বাবারা দেশকে স্বাধীন করেননি।”
বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে আহ্বান জানান ইশরাক।
“দেশের এই অপরাজনীতির চর্চা কতদিন চলবে। আপনারা জানেন, দেশের আছেন দুজন অভিভাবক। একজন হলেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যিনি জেলে রয়েছেন, আরেকজন অভিভাবক বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উনি। আমি এ দুজন অভিভাবকের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই আমাদের তরুণ প্রজন্মর ভবিষ্যৎটা কোথায়? আপনারা দুজনে কি এ সমাধান করে দেবেন না? আপনারা এই সমস্যার সমাধান করে দিন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।”
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে তার প্রাপ্য সম্মান তাকে দেওয়া হয়নি। তার শেষ ইচ্ছা ছিল, যে দেশ তিনি স্বাধীন করেছেন, সে দেশে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন। কিন্তু সরকারের সদিচ্ছার অভাবে সেটা হয়নি।”
তিনি বলেন, “দুটি কারণে ঢাকাবাসী তাকে দীর্ঘদিন মনে রাখবেন। একটি হল, তার সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ আক্রমণ থাকলেও তিনি অল্প সময়ে ও অল্প খরচে সেটা দূর মোকাবেলা করতে পেরেছেন। আরেকটি হল, ঢাকার বিভিন্ন সড়ক তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নামে করে দিয়েছেন।”
“এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশের সামনে বুক পেতে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘গুলি কর, আমার এখানে গুলি কর’। তার জোরালো কণ্ঠের ফলে পুলিশ তখন ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর পুরান ঢাকায় হিন্দুদের বাড়িঘর, মন্দির রক্ষায়ও তিনি ভূমিকা রেখেছিলেন।
“আজকে যখন গণতন্ত্রের নামে ফ্যাসিবাদ চলছে, গণতন্ত্রের জন্য মানুষ সংগ্রাম করছে- তখন ঢাকার রাজপথে খোকার মতো সাহসী যোদ্ধার খুব প্রয়োজন ছিল।”
আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী আবু সাইয়িদ বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তিনি গিয়েছিলেন, সেই লড়াই চালু রেখেছেন তিনি। মানুষের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন তিনি, মানুষও তাকে সেই সম্মান এখন দিচ্ছে।”
চলচ্চিত্রকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, “রাজপথের আন্দোলনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনে যুক্ত থাকতে আমরা তাকে দেখেছি। সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একজন রাজনীতিকের যে ভূমিকা থাকা দরকার, আমরা তার মধ্যে সেটা দেখেছি। আমরা খোকাকে ভুলতে দিব না, তার কাজ ধরে রেখে তাকে আজীবন মনে রাখব।”