কৃষক লীগের কাজ কৃষকদের নিয়ে করার কথা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সংগঠনটি আলোচনায় উঠেছে এর এক কেন্দ্রীয় নেতার কারণে, যার সঙ্গে কৃষির দূরতম সম্পর্কও নেই।
কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এই সদস্য হলেন মোহাম্মদ সফিকুল আলম ফিরোজ; রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের চেয়ারম্যান তিনি। ওই ক্রীড়া ক্লাবটিতে অবৈধ ক্যাসিনো বন্ধে র্যাবের অভিযানের পর গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে তিনি।
কৃষক লীগের এমন অনেক নেতা রয়েছেন, যাদের কৃষির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত এই কৃষক সংগঠনটিও কৃষির সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে।
কৃষক লীগের সম্মেলন ঘিরে এ নিয়ে আলোচনার মধ্যে সংগঠনটির সহসভাপতি বদিউজ্জামান বাদশাহও স্বীকার করে নিয়েছেন সাংগঠনিক এই দুর্বলতার কথা।
আর এজন্য বর্তমান নেতৃত্বকে দায়ী করে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন কৃষক লীগের তেমন কোনো কর্মকাণ্ড নেই। কৃষক লীগে চলছে কমিটি বাণিজ্য। ঢাকায় বাণিজ্য করে কমিটি দেওয়া হচ্ছে, আর নেতারা ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।”
কৃষি এলাকাবিহীন রাজধানীর বিভিন্ন থানায় কৃষক লীগের কমিটি গড়ে তোলা হয়েছে, যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও।
বঙ্গবন্ধুর গড়া এই সংগঠনের বর্তমান কর্মকাণ্ডে হতাশা প্রকাশ করেছেন কৃষকদের অন্য সংগঠনের নেতারাও। তারা বলছেন, কৃষক লীগ শুধু নামেই আছে, কোনো কাজে নেই।
আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন কৃষক লীগের স্লোগান হচ্ছে- ‘কৃষক বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’। সংগঠনের গঠনতন্ত্রে আছে, “বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ‘কৃষক বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’ মূলমন্ত্রে সারা দেশে কৃষক সমাজকে সংগঠিত করে কৃষক-জনতার সার্বিক উন্নয়ন সাধন করাই কৃষক লীগের মূল নীতি।”
সংগঠনের লক্ষ্যে বলা আছে- “কৃষকের কল্যাণে সময়োপযোগী, বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে অবিচল নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে নিজেকে আত্মনিয়োগ করা।”
অথচ তার কিছুই এখন চোখে পড়ে না। গত বছর ধানের দাম না পেয়ে কৃষকদের প্রতিবাদ যখন সারা দেশজুড়ে, তখনও সেখানে কৃষক লীগের কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি।
সবুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সব আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল কৃষক সমাজ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষকদের অধিকার রক্ষায় কৃষক লীগ গঠন করেছিলেন।
“কিন্তু আজ কৃষি জমি ধরে রাখা নিয়ে কৃষক লীগের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণে কৃষক লীগের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কৃষকদের ধানের দাম না পাওয়া নিয়েও কৃষক লীগের কোনো মাথা ব্যথা নেই। এক কথায় বলা যায়, কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই।”
গত বছর ধানের দাম পড়ে যাওয়ায় কৃষকদের স্বার্থে কৃষক সমিতির বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের বিষয়টি জানিয়ে সবুর বলেন, “কিন্তু সরকার সমর্থক কৃষক লীগের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখতে পাইনি।”
তবে কৃষক সমিতির এই নেতার কথার বিরোধিতা করেছেন কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক সামসুল হক রেজা।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সব সময়ই কৃষকদের অধিকার আদায়ে লড়াই সংগ্রামে ছিলাম, এখনও আছি।”
কর্মসূচি না থাকার বিষয়ে রেজা বলেন, “দল ক্ষমতায় থাকার কারণে আমরা মাঠে ময়দানে না থাকলেও কৃষকদের সব দাবি-দাওয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীকে অবহিত করি। এর ফলে কৃষকরা এখন সকল ধরনের সুবিধা পাচ্ছে।”
ধানের দাম নিয়ে গত বছর সারাদেশে কৃষকদের অসন্তোষর সময়ও কোনো কার্যক্রম না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা ওই সময়ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীকে কৃষকদের বিষয়ে কথা বলেছি এবং সেই আলোকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
“সব বিষয় নিয়ে আমাদের মাঠে নামতে হয় না, কারণ আমরা সরকারি দলের সহযোগী সংগঠন। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেই সমাধান করতে পারি।”
সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লা এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক রেজার নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিটির মেয়াদে কৃষক লীগকে শুধু দলীয় দিবসভিত্তিক কিছু কর্মসূচি দিতেই দেখা গেছে।
২০১২ সালের ১৯ জুলাই কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে এই কমিটি গঠিত হয়েছিল। তিন বছরের মেয়াদ হলেও প্রায় ৮ বছর ধরে চললে এই কমিটি।
সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বলেন, শুধু কেন্দ্রীয় কমিটি নয়, জেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোও ঝিমিয়ে পড়েছে। এসব কারণে কৃষক লীগের কর্মকাণ্ডেও ঝিমুনি ভাব।
আগামী ৬ নভেম্বর কৃষক লীগের সম্মেলনের তারিখ ঠিক করে দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ থেকে। এই সম্মেলন ঘিরে নতুন নেতৃত্ব গঠনের আলোচনা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
কর্মীদের প্রত্যাশা, আগামী সম্মেলনের মাধ্যমে যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসবে, যারা কৃষকের জন্য কাজ করবেন।
কৃষক লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “কৃষক লীগে কমিটিতে ৩৫ জনের মতো আইনজীবী রয়েছেন। সাধারণ সম্পাদক রেজা আইনজীবী হওয়ার কারণেই সংগঠনে আইনজীবীদের একটি বলয় তৈরি হয়েছে।”
বর্তমান সভাপতি মোতাহার মোল্লা এবং সাধারণ সম্পাদক রেজা আগামী কমিটিতেও নেতৃত্বে থাকতে চান; যদিও সংগঠনকে সচল করতে না পারার অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেই।
রেজা বলেন, “নেত্রীর (শেখ হাসিনা) ইচ্ছায় আমরা নেতৃত্ব দিচ্ছি, আমাকে আবার নেত্রী দায়িত্ব দিলে পালন করব।”
সভাপতি পদে কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক, সহ-সভাপতি শরীফ আশরাফ হোসেন,সহ-সভাপতি কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা ও সহ-সভাপতি শেখ মো. জাহাঙ্গীর আলমের নাম আলোচনায় রয়েছে।
সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সমীর চন্দ্র, সাংগঠনিক সম্পাদক বিশ্বনাথ সরকার বিটু, সাংগঠনিক সম্পাদক কৃষিবিদ সাখাওয়াত হোসেন সুইট, সাংগঠানক সম্পাদক আসাদুজ্জামান বিপ্লব, সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক গাজী জসিম উদ্দিনের নাম।
সম্মেলনে কাউন্সিলরা সারাদেশ থেকে এলেও তাদের ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচন হবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তেই কমিটি হবে বলে কৃষক লীগের নেতাদের কথায় আভাস মিলেছে।
রেজা জানান, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ১০ হাজারের মতো কাউন্সিলর ঢাকায় আসবেন। আর প্রতিনিধির সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়।