পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট বাবা-মাসহ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলে শেখ রাসেলকেও হত্যা করেছিল ঘাতকরা। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আমলে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ বন্ধ করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল।
অকালে হারিয়ে যাওয়া শেখ রাসেলের ৫৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, সেই সময় ওই শিশু হত্যাকারী, নারী হত্যাকারীদের বিচার হলে আজকে ‘এই ধরনের মানসিকতা গড়ে উঠত না’।
ভবিষ্যতে আর কোনো শিশু যেন হত্যার শিকার না হয় সে লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। শিশু হত্যাকারীদের কঠোর থেকে কঠোরতর সাজা নিশ্চিতের কথাও বলেন তিনি।
বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদ আয়োজিত এই আলোচনা সভায় সব ছোট ভাইকে নিয়ে আফসোস ঝরে প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে।
বেঁচে থাকলে এখন শেখ রাসেলের বয়স হত ৫৫ বছর।
শেখ হাসিনা বলেন, “এই বয়সে রাসেল কেমন হত দেখতে? আমি তার বড় বোন। আমি কোলে পিঠে করে তাকে আসলে মানুষ করেছি সব সময়। অতি আধুনিক ছিল সে, কিন্তু ঘাতকের নির্মম বুলেট তাকে বাঁচতে দেয়নি।”
১৯৬৪ সালের ১৮ই অক্টোবর ধানমণ্ডির স্মৃতি-বিজড়িত বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্ম নেন শেখ রাসেল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার সময় রক্ষা পাননি শিশু রাসেল। তখন তিনি ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।
বেদনার সেই স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “১৯৮১ সালে আমি ফিরে এসেছিলাম বাংলাদেশে। আমি চেষ্টা করেছিলাম মামলা করার। আমাকে বলা হল, এই হত্যার মামলা করা যাবে না। আমি আমার মায়ের হত্যার বিচার পাব না, ভাই হত্যার বিচার পাব না, আমার বাবার হত্যার বিচার পাব না। আমার প্রশ্ন ছিল, আমি কি এদেশের নাগরিক নই? সবাই যদি বিচার চাইতে পারে আমি বিচার চাইতে পারব না কেন?”
এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা চাই আর কোনো শিশু যেন এভাবে কখনো হত্যার সম্মুখীন না হয়। প্রত্যেকটা শিশু যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে আর প্রতিটি শিশুর জীবন যেন অর্থবহ হয় সেটাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।”
তিনি বলেন, “অন্যায়-অবিচার কখনোই বরদাস্ত করা হবে না। আজকে যারা এভাবে শিশু নির্যাতন বা শিশু হত্যা করবে তাদের কঠোর থেকে কঠোরতর সাজা পেতে হবে। অবশ্যই পেতে হবে।”
শিশুদের কল্যাণে নেওয়া সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “শিশুরা যাতে ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কাজ না করে সেই ধরনের ব্যবস্থাও নিয়েছি এবং তাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে তারা লেখাপড়ার যেন সুযোগ পায়। ঝরে পড়া শিশুদের ব্যবস্থাও আমরা করেছি। যারা একেবারে এতিম তাদের জন্য আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছি।
“যারা প্রতিবন্ধী তাদের তো কোনো দোষ নেই। কাজেই আমি আজকে এখানে শিশু যারা আছে তাদের একটা কথাই বলব, তোমরা যারা ছোট এখনও তোমাদের আশপাশে যখন দেখবা কেউ প্রতিবন্ধী অথবা দরিদ্র তাদেরকে কখনও অবহেলা করো না। তাদেরকে আপন করে নিও। তাদের পাশে থেক। তাদের সহযোগিতা করো। কারণ তারাও তো তোমাদের মতনই একজন।”
মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ থেকে দূরে থাকার পাশাপাশি সততার সঙ্গে জীবনযাপনের পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী।
শিশুদের পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “কেউ কখনো নিজেকে ছোট মনে করবে না। এটা আমার একটা অনুরোধ থাকবে। আমি মনে করি, সব শিশুর ভেতরেই একটা সুপ্ত চেতনা রয়েছে, মনন রয়েছে, শক্তি রয়েছে এবং সেটা বিকশিত করতে হবে। তুমি নিজেকে কতটুকু পারদর্শী করে গড়ে তুলতে পারো লেখাপড়া খেলাধুলা বা সংস্কৃতি চর্চা সবকিছুতে কতটা নিজেকে গড়ে তুলতে পারো সেটা হচ্ছে সব থেকে বড় অলংকার, সেটাই হচ্ছে সব থেকে বড় শক্তি।
“সততার সঙ্গে জীবনযাপন করলে সব সময় নিজের ভেতরে এমনিতেই শক্তি সঞ্চার হয়। কারও কাছে তখন মাথা নত করে চলতে হয় না।”
তিনি বলেন, “আমি চাই এই সংগঠনের প্রতিটা ছেলে-মেয়ে নিজেদের এই কথাটা মনে রেখে তৈরি করবে। শুধু আমি নিজে পাব, নিজে করব সেটা না। কতটুকু আমার আশপাশে শিশুদেরকে দিতে পারি, কতটুকু তাদের পাশে দাঁড়াতে পারি। দরকার হলে নিজের খাবার ভাগ করে খাবে এটা কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব করতেন “
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আজকে রাসেল আমাদের মাঝে নেই। আমি রাসেলকে হারিয়েছি। কিন্তু এই শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদের মাধ্যমে আমি হাজার হাজার লাখো রাসেলকে পেয়েছি। আমার দোয়া আমার আশির্বাদ সব সময় তোমাদের সাথে থাকবে।”
অনুষ্ঠানে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান মো. রকিবুল রহমান, মহাসচিব মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সচিব কে এম শহীদুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।