শুক্রবার বিকালে যখন বুয়েটছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উপাচার্যের বৈঠকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হয়, সে সময় চট্টগ্রামে এক সভায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের বিপক্ষে কথা বলেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
“মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলতে হবে এটা মানতে আমি রাজি নই। যখনই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে তখনই মৌলবাদীরা সুযোগ নেবে। অতীতে এটাই হয়েছে।”
‘উদ্ভূত পরিস্থিতি সামালে’ বুয়েট কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও মেননের মতো একই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সাবেক ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক।
“তবে বুয়েটে যেন ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করায় সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান না ঘটে, সেই বিষয়ে প্রশাসনকে নজর রাখতে হবে।”
যে হত্যাকাণ্ডের জের ধরে বুয়েটের ছাত্র-শিক্ষকরা এই সিদ্ধান্ত নিলেন, সেই আবরার হত্যার জন্য ছাত্র রাজনীতিকে কোনোভাবেই দায়ী করা যায় না বলে মনে করেন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি সেলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বরং ছাত্র রাজনীতি না থাকার কারণেই আবরার হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। এই জন্য সমাধান হল- ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ নয়, দুর্বৃত্তায়িত শক্তিকে অপসারণ করে এবং ছাত্র রাজনীতি স্বাধীনভাবে করতে দিতে হবে। ছাত্র রাজনীতি কমানো নয়, তা উন্মুক্ত করে দেওয়াই হবে সমাধান।”
বুয়েটে ছাত্র হত্যার চেয়ে ‘বড় বড় অপরাধ’ জাতীয় রাজনীতিতে চলছে মন্তব্য করে এই বাম নেতা প্রশ্ন করেন, “তাহলে কি জাতীয় রাজনীতি বন্ধ করে দিতে হবে? মাথা ব্যাথা হলে কি মাথা কেটে দিতে হবে?”
“সেখানে ছাত্র ইউনিয়নকে কোনো কাজ করতে দেওয়া হয় না। বাম সংগঠনকে কাজ করতে দেওয়া হয় না। সেখানে ছাত্র রাজনীতি নেই, আছে ক্ষমতাসীনদের একক ফ্যাসিস্ট-দখলদারিত্ব।”
ছাত্র রাজনীতি দুই দিক থেকে ‘হামলার শিকার হচ্ছে’ বলে মনে করেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
“একটা হলো ফ্যাসিস্ট-দখলদারিত্বের শক্তি, আরেকটি নতুন আক্রমণ বিরাজনীতিকরণের সুশীল সমাজীয় ফর্মুলা- ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার চেষ্টা।”
বুয়েটের এই সিদ্ধান্ত জাতীয়ভাবে ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন জাতীয় সমাসতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু।
ছাত্র অঙ্গনে রাজনৈতিক চর্চার অধিকার ‘সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সুতরাং বুয়েট স্থানীয় ঘটনার প্রেক্ষিতে সাময়িক সময়ের জন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করছি। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই।
“জাতীয় পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার কোনো কারণ দেখছি না। যেটা বন্ধ করা দরকার তা হল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো দলের ‘ঠ্যাঙ্গারে’ বাহিনী থাকবে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার আইন-কানুন অনুসারে ছাত্র রাজনীতি পরিচালনা করবে।”
এদিকে বাংলাদেশ জাসদের প্রেসিডিয়াম সদস্য ডা. মুস্তাক হোসেন বলছেন, রাজনীতি নিষিদ্ধ করা নিয়ে বুয়েট প্রশাসনের বক্তব্যে ‘স্পষ্ট’ হতে পারেননি তিনি।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ডাকসুর নেতৃত্বে থাকা মুস্তাক হোসেন বলেন, “রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে তার সাথে আমি একমত। তবে যদি ঢালাওভাবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে সেখানে কথা আছে।”
বুয়েট কর্তৃপক্ষের রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তে সেখানে সমস্যা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসা বদিউজ্জামান সোহাগ।
তিনি বলেন, “বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ- এটা কোনোভাবেই সাপোর্ট করি না। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করলে সমস্যা আরও বাড়বে। তাছাড়া বুয়েট প্রশাসন সব সময়ই রাজনীতি মুক্ত ছিল। ছাত্র রাজনীতির প্রভাব কোনো সময়ই বুয়েট প্রশাসনের উপর ছিল না।”
ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয়ও মনে করছেন এতে সমস্যা আরও প্রকট হবে।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, “কেউ কি নিশ্চয়তা দিতে পারবে যে, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে আর কোনো সমস্যা হবে না? এতে সমস্যা আরও বাড়বে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ থাকলে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, যা প্রতিষ্ঠান ও দেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। বুয়েট প্রশাসনের কাছে অনুরোধ থাকবে ভবিষ্যতে যেন বিষয়টি বিবেচনা করা হয়।”
তবে ছাত্রলীগের এই দুই নেতার থেকে ভিন্নভাবে বিষয়টিকে দেখছেন ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি বাকী বিল্লাহ।
তার মতে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধে বুয়েটে ভবিষ্যতে ছাত্র আন্দোলন হবে না, তা তিনি মনে করেন না।
“এখানে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। বরং ছাত্রদের টুটি চেপে ধরা এই পেশিশক্তিনির্ভর ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে তাতে ছাত্রদের কথা বলার সুযোগও তৈরি হতে পারে।”
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে অভিমত জানতে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি। পরবর্তীতে এ বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত জানানো হবে বলে জানান ছাত্রদলের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক।
এ বিষয়ে ছাত্রদলের সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বুয়েটে যে ঘটনাটি ঘটল এখানে যে দায়ী সংগঠন সেই সংগঠনকে নিষিদ্ধ না করে নিষিদ্ধ করা হল ছাত্র রাজনীতিকে। আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি সবগুলো ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করা হয় এবং সবগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয় তাহলে এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না। ছাত্রলীগের হাতেও একক কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। ছাত্রলীগ এখন লাগামহীন হয়ে গেছে। তাই ছাত্ররাজনীতি নয়, ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে।”
এদিকে বুয়েট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি আল কাদেরী জয় ও সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স।
তাদের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এটি একটি ভয়ঙ্কর অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত এবং সকল ধরনের বিরোধী মত ও তার ভিত্তিতে সংগঠিত শক্তিকে দমনের একটি হাতিয়ার। এটি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে একটি প্রতারণাও বটে।”
ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেই ‘খুনি উৎপাদন’ ও অত্যাচার বন্ধ হবে না মন্তব্য করে ছাত্রফ্রন্ট নেতারা বলেন, “এই অত্যাচার বন্ধের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সংগ্রাম।”
বুয়েট কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মঞ্চ প্রগতিশীল ছাত্র জোট।
“বুয়েট প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা আমরা মনে করি সঠিক না। যেসব সংগঠন চাঁদাবাজি, খুন এসবের সাথে জড়িত তাদের নিষিদ্ধ করা দরকার ছিল। কিন্তু ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে তারা এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকেই সুযোগ করে দিল, যারা গোপনে রাজনীতি করে। আমরা এই সিদ্ধান্তকে অগ্রহণযোগ্য ও অগণতান্ত্রিক হিসেবে বিবেচনা করি। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বুয়েট প্রশাসন হয়ত সামনের দিনে চিন্তা করবে।”