যুবলীগের সম্রাটের অফিসে অস্ত্র, ইয়াবা, ক্যাঙ্গারুর চামড়া

ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তার যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের কাকরাইলের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, ইয়াবা, একটি পিস্তল ও দুটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে র‌্যাব।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 Oct 2019, 08:14 AM
Updated : 6 Oct 2019, 07:21 PM

সম্রাটকে সঙ্গে নিয়েই একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে রোববার দুপুর থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের ওই কার্যালয়ে র‌্যাবের অভিযান চলে।

কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার আলকরা ইউনিয়নের কুঞ্জশ্রীপুর গ্রামের একটি বাড়ি থেকে শনিবার গভীর রাতে গ্রেপ্তার করা হয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি সম্রাট ও সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমানকে।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার মতিঝিলের ক্লাবপাড়ায় র‌্যাবের অভিযানে অবৈধ ক্যাসিনো চলার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই আলোচনায় ছিলেন তারা।

গ্রেপ্তারের পর তাদের ঢাকায় র‌্যাব সদরদপ্তরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে বেলা দেড়টার দিকে হেলমেট পরিহিত সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে কাকরাইলের ভূইয়া ট্রেড সেন্টারের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে দেখা যায় র‌্যাব সদস্যদের।

একই সময়ে শান্তিনগরে শেলটেক টাওয়ারের পঞ্চম তলায় এবং মহখালী ডিওএইচএসের ২৯ নম্বর সড়কে সম্রাটের দুটি বাসায় এবং মিরপুর দুই নম্বর সেকশনে অভিযান শুরু করে র‌্যাব।

টানা পাঁচ ঘণ্টার অভিযান শেষে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম সাংবাদিকদের জানান, যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের অফিসে তল্লাশি চালিয়ে গুলিসহ একটি বিদেশি পিস্তল, ১১৬০টি ইয়াবা, ১৯ বোতল বিদেশি মদ, দুটি ক্যাঙ্গারুর চামড়া পেয়েছেন তারা।

এছাড়া সেখানে দুটি বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ও দুটি লাঠি পাওয়া গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেগুলো নির্যাতন করার কাজে ব্যবহার করা হত বলে তাদের ধারণা।

অভিযানের নেতৃত্বে থাকা র‌্যাবের নির্বাহী মেজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, অভিযানের সময় সম্রাটের বিরুদ্ধে ‘তিন ধরনের অপরাধের আলামত’ পেয়েছেন তারা। এর একটি বন্যপ্রাণী আইনে, বাকি দুটি মাদক ও অস্ত্র আইনে।

ক্যাঙ্গারুর চামড়া পাওয়ার কারণে সম্রাটকে বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) আইনে তাৎক্ষণিকভাবে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া মাদক ও অস্ত্র পাওয়ায় তার বিরুদ্ধে আরও দুটো মামলা করা হবে বলে নির্বাহী মেজিস্ট্রেট জানান।

তিনি বলেন, কুমিল্লায় অভিযানের সময় যুবলীগ নেতা আরমানকে মদ্যপ অবস্থায় পাওয়া যায়। এ কারণে ভ্রাম্যমাণ আদালত তাৎক্ষণিকভাবে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠায়।

সম্রাট এতাদিন কোথায় ছিল- এমন প্রশ্নে সারোয়ার বিন কাশেম বলেন, “এটা তদন্ত ছাড়া বলা যাবে না। তাকে রিমান্ডে নিয়ে তথ্য জানার চেষ্টা করা হবে।”

অভিযানের শুরুতেই র‌্যাব সদস্যরা ভূইয়া ট্রেড সেন্টারের সামনে অবস্থান নেন, ভবনের প্রধান ফটকের কলাপসিবল গেইট আটকে দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় নিচতলার সব দোকানপাট।

র‌্যাবের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যরাও কাকরাইলের রাজমনি ঈশা খাঁ হোটেলের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে থাকেন। পুরোটা সময় চারপাশে ভিড় করে থাকে বিপুল সংখ্যক উৎসুক জনতা।

ভবনের সামনে সাইনবোর্ডে লেখা ছিল যুবজাগরণ পাঠাগার, প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ।

সেই সাইনবোর্ডের নিচে দুটি পিলারের একটিতে যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী, অন্যটিতে সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদের ছবি এবং হারুনের ছবির নিচেই ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের হাস্যোজ্জ্বল ছবি ঝোলানো দেখা যায়।

স্থানীয়রা জানান, এই ভবনেই সম্রাট দিনের বড় একটি সময় কাটাতেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিয়ান শুরুর পরও কয়েক দিন তিনি অফিসে ছিলেন। শতাধিক যুবক তখন ওই ভবন পাহারা দিয়ে রেখেছিল।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর ইয়ংমেনস ফকিরেরপুল ক্লাবে অভিযান এবং যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূইয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর সদলবলে কাকরাইলের কার্যালয়ে অবস্থান নিয়ে রাতভর সেখানে ছিলেন সম্রাট। কয়েক দিন পর তিনি নিরুদ্দেশ হন।

সেদিন র‌্যাবরে অভিযানের সময় মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্রের ভেতরে সম্রাটের বিশাল ছবি দেখা যায়। ওই ক্লাবের ক্যাসিনো তিনিই চালাতেন এবং মতিঝিল ক্লাবপাড়ায় অন্য ক্যাসিনোগুলো থেকেও প্রতিদিন নির্দিষ্ট হারে চাঁদা তার কাছে যেত বলে গণমাধ্যমে খবর আসে।

সম্রাটের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত যুবলীগ নেতা আরমানও দীর্ঘদিন ধরে ক্যাসিনোর কারবারে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি তিনি ঢাকাই সিনেমাতেও টাকা খাটাচ্ছিলেন।

আরমানের প্রোডাকশন হাউস ‘দেশ বাংলা মাল্টিমিডিয়া’র ব্যানারে প্রথম সিনেমাটি মুক্তি পায় গত কোরবানির ঈদে। ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’ নামের ওই সিনেমায় অভিনয় করেছেন শাকিব খান ও বুবলী।

শান্তিনগরে সম্রাটের বাসা

সম্রাটের অফিস থেকে উদ্ধার করা পিস্তল ও গুলি

মহাখালীতে অভিযান শেষে র‌্যাব-২ অধিনায়ক আশিক বিল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরী ছাড়াও শারমিনের ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী ওই বাসায় থাকেন। তল্লাশি চালিয়ে অবৈধ কিছু সেখানে পাওয়া যায়নি।

“শারমিন বলেছেন, সম্রাট গত কয়েক বছর ধরে এই বাসায় যান না। তবে প্রতিমাসে দেড় লাখ টাকা করে খরচ দিয়ে আসছিলেন।”

আর সম্রাটের স্ত্রী শারমিন সাংবাদিকদের বলেন, “ওর সম্পদ বলতে কিছুই নাই। ও ক্যাসিনো চালায়া যা ইনকাম করে তা দলের জন্য খরচ করে, দল চালায়। আর যা থাকে তা দিয়া সিঙ্গাপুরে বা এখানে জুয়া খেলে। ও যে ক্যাসিনো চালিয়ে দল চালায় সেটা তার জনপ্রিয়তা দেখে বোঝা যায়।”

বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে শন্তিনগরের অভিযান শেষ করে সেখানে ‘কিছু টাকা আর ক্রেডিট কার্ড’ পাওয়ার কথা জানিয়ে র‌্যাব- ৩ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, “এর বাইরে সিগনিফিকেন্ট কিছু আমরা পাইনি।”

আর মিরপুরে আরমানের বাসায় অভিযান শেষে সন্ধ্যায় র‌্যাব-৪ অধিনায়ক মো. মোজাম্মেল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,

সেখানে বিভিন্ন ব্যাংকের ১২টি চেকবই এবং আরমানের সই করা ২২টি খালি স্ট্যাম্প পেপার পাওয়া যায় বলে র‌্যাব-৪ এর অ্যাডজুটেন্ট জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম সজল জানান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আরমানের বাসায় কাউকে পাওয়া যায়নি। তালা ভেঙ্গে ঢুকতে হয়েছে। আমরা জেনেছি, ভোরের দিকে দুই ছেলে এক মেয়েকে নিয়ে আরমানের স্ত্রী বাসায় তালা মেরে বের হয়ে গেছেন।”