এইডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নেওয়ায় এর থেকে মুক্তি পেতে জনগণকে সাথে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি সরকারি সফরে প্রায় দুই সপ্তাহ লন্ডনে আছেন।
ওই নির্দেশনার পর সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে অভিনয় জগতের তারকাদের নিয়ে মন্ত্রী ও মেয়রের রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার ছবি ফেইসবুকে সমালোচনার ঝড় তুলেছে। পরিষ্কার রাস্তায় ময়লা ফেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের তা পরিষ্কারের ঘটনাও সমালোচনা তৈরি করেছে।
এদিকে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এইডিস মশা নিধনে আওয়ামী লীগ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম শুরু করলেও তা ঠিকমতো হচ্ছে না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
এই অবস্থার মধ্যে মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “কার্যকর ওষুধ কেনার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশ দিতে হয়েছে। সরকারের একজন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, দলেরও বিশেষ দায়িত্বে আছেন নাম বলতে চাই না, ব্যক্তিগত বন্ধু আমার। উনি জানিয়েছেন, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) ওখান থেকে (লন্ডন) প্রতিদিন নাকি নজরদারি রাখছেন কোথায় কোথায় ডেঙ্গুর কী কী হচ্ছে, তার কী কী করতে হতে পারে। আমি অবাক হয়ে যাই- লন্ডন থেকে কোথায় কোথায় এইডিস মশা কোথায় ডিম পাড়ে এটা দেখা যায় নাকি?
দায়িত্বশীলদের প্রচারমুখিতার সমালোচনায় তিনি বলেন, “এরা এখন পর্যন্ত মশা মারার কার্যকর ঔষধ আনতে পারে নাই। কিন্তু মশা মারবার নাটক করে বেড়াচ্ছে। মানে সিনেমার শিল্পীদের নামিয়ে দিয়েছে, সব কৌতূক অভিনেতাদের নামিয়ে দিয়েছে, বিভিন্ন লেখক-টেখকদের নামিয়ে দিয়েছে এবং ঝাড়ু হাতে একটা দেখবার মতো দৃশ্য! ঘরে ঘরে ছবি টাঙিয়ে রাখতে পারেন- এ রকম দৃশ্য দেখানো হচ্ছে- ঝাড় দিচ্ছে।
“মাটির মধ্যে বোধ হয় ডেঙ্গু মশা আছে, মাটির মধ্যে বোধ হয় লার্ভা আছে- এগুলো করে ছবি তোলার যে কী পাঁয়তারা চলছে- দেখলে নিজের ঘা ঘিন ঘিন করে। আমরা যে এত নিচে নামতে পারি- এটা আগে বোঝা যায়নি যা এখন দেখা যাচ্ছে। বুঝতেই পারেন সবাই- সিনেমার এক-একজন চিত্রতারকা সামনে আছেন আমাদের ইনফরমেশন মিনিস্টার। উনি থাকলে সবার থাকতে হয়। অনেকটাই জোর করে, বল প্রয়োগ করে, ভয় দেখিয়ে যে কোনোভাবে তাদেরকে এই নাটক করতে বাধ্য করা হচ্ছে।”
ডেঙ্গুর প্রকোপের মধ্যে সস্ত্রীক বিদেশ সফরে যাওয়ায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকেরও কঠোর সমালোচনা করেন বিএনপির জোট শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মান্না।
“পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিদেশে যান পরিবারিক সফরে। হেলথ মিনিস্টার ইজ অ্যা রিয়েল ‘সারপ্রাইজ গাই’। এ রকম বিস্ময়কর মানুষ বোধ হয় আমরা মন্ত্রিসভায় আগে দেখিনি। গতকালকে তিনি (স্বাস্থ্যমন্ত্রী) বলেছেন, ডেঙ্গু মোকাবেলা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আছে।
“এ রকম মূর্খ, অকালকুষ্মাণ্ড, কাজ করতে পারে না শুধু কথা বলে- এ রকম যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের হাতে দেশ তো নিরাপদ নয়, আমরা কেউ নিরাপদ নই। আজকে ধরেন এইডিস মশার কারণে, কালকে দেখবেন যে খুন করেছে, গুম করেছে, নানাভাবে এই সরকার কেবলমাত্র বাচালতা করছে আর কিছু না।”
আলোচনায় নর্থ সাউথ ও শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত ঢাকার ছয়টি উদ্যানে ওই গবেষণা চালায় তারা।
“সেখানে দেখা যায়, শুধু বলধা গার্ডেনে এইডিস মশার উপস্থিতি আছে। এই জায়গাটা সরকার যদি অ্যাড্রেস করত এবং এইডিস মশা মেরে ফেলতে পারত তাহলে সম্ভবত বংশ বিস্তারের এই জায়গাটা যদি আমরা নির্মূল করতে পারতাম কিন্তু সেটা করা হয়নি।”
এখন দিনে দুই হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় এই মশা বিস্তারের মওসুমের বাকি তিন মাসে ভয়াবহতা কেমন হবে, নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন মান্না।
ডেঙ্গু মোকাবেলায় ব্যর্থতার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং ঢাকার দুই মেয়রের পদত্যাগ দাবি করেন তিনি।
সরকারের জবাবদিহি না থাকায় এই অবস্থা তৈরি হয়েছে মন্তব্য করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে শরিক হতেও সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এই নেতা।
“গণতান্ত্রিক সরকার না আসলে, জবাবদিহির সরকার না আসলে এই অবস্থার পরিবর্তন আসবে না। তাই আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, রুখে দাঁড়ানোর এখনই সময়। সকল গোষ্ঠী-পরিবার ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকক চিন্তা বাদ দিয়ে সামষ্টিক চিন্তা করতে হবে।”
আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক সচিব এএইচএম মোফাজ্জল করীম বলেন, “ডেঙ্গু নিয়ে ব্লেইম গেইম হচ্ছে। সিটি মেয়র বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দোষ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন এটা সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতা। মাঝখান থেকে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী, ডেঙ্গু বিস্তারকারী যে এইডিস বিবি, এই এইডিস বিবি চেঙ্গিস খানের মতো দুর্দান্ত প্রতাপে তিনি সবখানে আক্রমণটা চালিয়ে যেতে থাকলেন এবং অতি শিগগিরই তিনি রাজধানী ঢাকা শহর দখল করে ফেললেন।
“তারপরে তিনি তার বাহিনী নিয়ে চলে যাচ্ছে মফস্বল শহরে। আশ্চর্য ডেঙ্গু আসতে পারে- এটা নতুন কোনো ব্যাপার নয়। মহামান্য হাই কোর্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, সেই নির্দেশনা উপেক্ষিত হয়েছে। তারপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেই কবে একটা রেড এলার্ট জারি করেছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ডেঙ্গু আসছে মহামারি আকারে- তারও কোনো রকমের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে আমরা শুনিনি। যখন শুরু হয়ে গেল মহামারি আকারে তখন তারা বলছেন, ‘সব ঠিক হায়’, সব নিয়ন্ত্রণে আছে। এই যে আচরণ শাসকগোষ্ঠীর এটা কেন? এটা হয়েছে এজন্য যে, দেশের নেতৃত্ব এখন একটা জবাবদিহিহীন নেতৃত্বের হাতে পড়েছে। এদের কোনো জবাবদিহি নেই।”
“এখন আরেকটা সংযোজন হল ভবিষ্যত প্রজন্ম পড়বে। নিশিত ভোটের দেশ কোনটা? বাংলাদেশ। আপনারা সবাই জেনেছেন উত্তরটা। আপনাদের নাতি-পুতিদের শিখিয়ে দেবেন। ছি, ছি,। আর কত লজ্জা দেবেন আপনারা?”
জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মানিক মিয়া হলে জাতীয় মুক্তিমঞ্চের উদ্যোগে ‘ডেঙ্গু মহামারী, ভয়াবহ বন্যা, অপর্যাপ্ত ত্রাণ ব্যবস্থা, রাজনৈতিক সংকট, নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থাসহ বিরাজমান পরিস্থিতি: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এই আলোচনা সভা হয়।
আলোচনায় মুক্তিমঞ্চের প্রধান অলি আহমদ দেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মতো ঐক্য প্রত্যাশা করেন।
তিনি বলেন, “আমাদের এই মুক্তিমঞ্চের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, দেশের জনগণকে মুক্তি দেওয়া। আমি সবাইকে অনুরোধ করব, নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ, নিজের অবস্থান ভুলে জনগণকে বাঁচানোর জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যেভাবে এগিয়ে এসেছিলেন, এই মঞ্চে আমি বলেছিলাম- হয় মুক্তি হবে নাহলে মৃত্যু হবে।
“এই প্রতিজ্ঞা করে আজকে সকলে আসুন- দেশকে বাঁচান, দেশের জনগণকে বাঁচান।”
কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, নেয়ামুল বশির, বিএনপির সারোয়ার হোসেন, জাতীয় দলের এহসানুল হুদা, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মুফতি মুনির হোসেন, কল্যাণ পার্টির জাহেদ আবেদীন, সাংবাদিক মোস্তফা কামাল মজুমদার, ভিআই হসপিটালের চিকিৎসক একেএম ওয়ালিউল্লাহ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।