অবিশ্বাস-আস্থাহীনতায় ঐক্যহীন ঐক্যফ্রন্ট

একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে হাঁকডাক দিয়ে বিএনপিকে নিয়ে কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হলেও ভোটের পর ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে এই জোট।

সুমন মাহমুদ প্রধান রাজনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 July 2019, 02:10 PM
Updated : 23 July 2019, 03:14 PM

এই জোটের নেতাদের পারস্পরিক আস্থাহীনতার বিষয়টি ইতোমধ্যে প্রকাশ্য হয়েছে গত ১০ জুলাই আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর জোট ছাড়ার মধ্য দিয়ে।

কৃষক, শ্রমিক, জনতা লীগের সভাপতির যুক্তি ছিল, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে যে জোট তারা গড়েছিলেন, নির্বাচনের পর গত সাত মাসে তার কোনো অস্তিত্ব এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

“জাতীয় কোনো সমস্যাকে তারা তুলে ধরতে পারছে না। এরকম একটি জোট যে আছে, তা দেশের মানুষ জানেই না।”

এই অবস্থায় ঐক্যফ্রন্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে দলগুলোর কর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে; ঐক্যফ্রন্ট আদতে আছে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান তারা।

ঐক্যফ্রন্টভুক্ত জেএসডির সমর্থক পল্টনের একটি ফার্মেসির বিক্রয়কর্মী বশির আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যা, গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি, বরগুনার রিফাত হত্যাসহ বিভিন্ন ঘটনায় আপনি দেখবেন ফ্রন্ট নিশ্চুপ, ফ্রন্টের শীর্ষ নেতার বিবৃতি নেই।

“এসব দেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আছে বলে মনে হচ্ছে না। এই জোটটি এখন তামাদি হয়ে গেছে।”

এখন আলাদা কর্মসূচি নিয়েই এগোতে দেখা যাচ্ছে ঐক্যফ্রন্টের দলগুলোকে।

গত সোমবার গণফোরামের এক সংবাদ সম্মেলনে জোটের শীর্ষনেতা কামাল হোসেনকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিল, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আছে কি না?

জবাবে তিনি বলেন, “ওইটা (জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট) তো একটা নির্বাচনকে সামনে রেখে করা হয়েছিল। মূল্য লক্ষ্য ছিল নির্বাচন, মূল লক্ষ্য রেখে সেই ফ্রন্ট হয়েছিল। সেই মূল লক্ষ্য তো আমাদের থাকবেই।

“তবে এখন বন্যা সারাদেশে। আমি মনে করি, এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নয়, জনগণের আসল ঐক্য প্রয়োজন। এখানে কয়েক দলের ঐক্য নয়, সকল দল ও জনগণের ঐক্যকে আমি বেশি গুরুত্ব দিতে চাই।”

ভোটের ফল প্রত্যাখ্যান করে সংবাদ সম্মেলনে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা

ঐক্যফ্রন্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কোনো কর্মসূচি নেই। তবে ভবিষ্যতে ফ্রন্টের কী অবস্থান হবে এবং কী কর্মসূচি হবে, তা আলোচনা করে ঠিক করা হবে।”

ঐক্যফ্রন্টকে এগিয়ে নেওয়ার ভাবনা যে এই মুহূর্তে তাদের নেই, দুজনের কথায় স্পষ্ট। বিএনপি এখন দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তি দাবিতে বিভাগীয় সমাবেশ নিয়ে ব্যস্ত; গণফোরাম দিচ্ছে বন্যাকে গুরুত্ব।

ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দল জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে রয়েছেন এখন। আরেক দল নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাও বিদেশে, লন্ডন থেকে মঙ্গলবার তার দেশে ফেরার কথা।

খবর নিয়ে জানা গেছে, গত দেড় মাসে ফ্রন্টের স্টিয়ারিং কিংবা কো-অর্ডিনেশন কমিটির কোনো বৈঠক হয়নি। ফ্রন্টের পক্ষে কোনো বিবৃতিও দেওয়া হয়নি।

গত ১০ জুন সর্বশেষ ফ্রন্টের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম ‘জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি’ বৈঠক বসেছিল উত্তরায় রবের বাড়িতে। সেই বৈঠকে কামাল হোসেনের থাকার কথা থাকলেও অসুস্থতার কথা বলে তিনি যাননি।

গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের আগে ১৩ অক্টোবর কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তখন জোটে ছিল বিএনপি, জেএসডি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া। পরে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগও এতে যোগ দিয়েছিল।

জাতীয় প্রেস ক্লাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সংবাদ সম্মেলনে জোটের নেতারা

ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর বিএনপি তাদের আগের জোট ২০ দলকে দৃশ্যত নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। এই জোট গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে যোগ নেওয়ার পর নির্বাচনেও অংশ নেয় বিএনপি; যদিও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কিংবা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি তাদের পূরণ হয়নি।

নির্বাচনের পর ফল প্রত্যাখ্যান পর্যন্ত এক সঙ্গেই ছিলেন জোটের নেতারা। কিন্তু আকস্মিকভাবে গণফোরামের সুলতান মো. মনসুর আহমেদ এমপি হিসেবে শপথ নিয়ে ফেললে দেখা দেয় পারস্পরিক অবিশ্বাস।

তখন বিএনপিও তার বিরোধিতা করলেও পরে তারাও অবস্থান বদলে সংসদে যোগ দেয়; তবে দুই দলের অবস্থান নিয়ে অন্যদের মনে প্রশ্ন থেকেই যায়। এনিয়ে বিএনপির আগের জোট থেকে বেরিয়েও যায় তাদের পুরনো সঙ্গী বিজেপি।

ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর জোট পরিচালনার জন্য গঠন করা হয় জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি, যার নেতৃত্বে ছিলেন কামাল হোসেন। গত ৮ মাসে স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক হয়েছে ২৬টি, এর মধ্যে কামাল ছিলেন ২১টিতে।

নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশনের স্মারকলিপি প্রদান, নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ধর্ষিত নারী ও সিলেটে ছাত্রদলের নেতাকে দেখতে যাওয়া, নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে গণশুনানী ও জাতীয় প্রেস ক্লাবে মানববন্ধন ছাড়া ফ্রন্টের কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি।

বিভাগীয় শহরগুলোতে গণশুনানি ও সমাবেশের ঘোষণা এলেও সেই কর্মসূচি আলোর মুখ দেখেনি। নুসরাত হত্যা নিয়ে ঢাকায় শাহবাগের সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করলেও তাও পরে স্থগিত করে।

অবিশ্বাস-আস্থাহীনতা

জোট বাঁধলেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলোর মধ্যম পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছিল; এখন উচ্চ পর্যায়েও তা ছড়িয়েছে।

বিএনপি শুরু থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিটি সামনে আনতে চাইলেও তাতে সাড়া পাননি অন্য দলগুলোর কাছ থেকে; যা নিয়ে বিএনপি মহাসচিব ফখরুলকেও দলে চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একদলীয় ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেলো, সেখানে ফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো কথা বলতে চান না, তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন গণতন্ত্রের নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা বলতে চান না।

“বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান দল। ড. কামাল এই ফ্রন্টের নেতৃত্বে আছেন, অথচ বিএনপি নেত্রীসহ নেতা-কর্মীদের মুক্তি চাইবেন না! এটা কি হতে পারে?”

ভোটের আগে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা

বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিব বলেন, “বিরোধী রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সব চাপ পড়ে বিএনপির উপর। মামলা-মোকাদ্দমাও হয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। অথচ ঐক্যফ্রন্টের নেতারা সে বিষয়ে কোনো চাপ নিতে চান না। এমনটা হলে ফ্রন্টের প্রয়োজন নেই।”

বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কর্মী আলতাফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ড. কামাল সাহেব সারাক্ষণ সভা-সমাবেশে ‘বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু’ বলেন। তিনি দেশনেত্রীর মুক্তির কথা বলতে চান না। এটা হলে কেন আমরা তাকে নেতা বলব।”

স্বেচ্ছাসেবক দলের সূত্রাপুরের কর্মী বিকাশ দত্ত বলেন, “জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে বিএনপির কোনো লাভ হয়নি। এই জোটের মাধ্যমে ড. কামাল লাভবান হয়েছেন বলে আমি মনে করি। এই ফ্রন্টে বিএনপির থাকার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।”

চলতি মাসের প্রথম দিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের বিষয়টি আলোচনায় উঠেছিল। সেখানে অধিকাংশ স্থায়ী কমিটির সদস্য মত দেন, এখন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি নিয়ে মাঠে দলীয় কর্মসূচি দেওয়া উচিত। কারণ কামাল হোসেন এ বিষয়ে কথা বলতে চান না।

“সেক্ষেত্রে আমাদের ফ্রন্ট নিয়ে বেশি সময় নষ্ট করে লাভ নেই। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি হওয়ার পরে তিনিই ঠিক করবেন ফ্রন্টের ভবিষ্যৎ কী হবে,” বলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির ওই সদস্য।

খালেদা জিয়ার কারামুক্তির দাবিতে গত ১৮ জুলাই বরিশাল ও ২০ জুলাই চট্টগ্রামে সমাবেশ করেছে বিএনপি। আগামী বৃহস্পতিবার খুলনায় এবং ২৯ জুলাই রাজশাহীতে সমাবেশ করবে তারা।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা অতীতে বিএনপি, ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছি। এখনও আমরা উভয় জোটেই আছি। আমরা দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি। সময়-সুযোগ ও পরিস্থিতি বুঝে ২০ দলীয় জোট ও ফ্রন্টের কর্মসূচি করব।”

ঐক্যফ্রন্টের এক সভায় নেতারা

এদিকে গণফোরামের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা নাম প্রকাশ করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিএনপির কর্মকাণ্ডে ড. কামাল হোসেন খুশি নন।”

দলটির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “ড. কামাল হোসেন নিজেই চাননি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সক্রিয় হোক। তিনি সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থানের বিরুদ্ধে। তার উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে গণফোরামকে প্রতিষ্ঠিত করা। সেই কাজটি হয়ে গেছে বলে এখন তিনি এই ফ্রন্টের বিষয়ে তত আগ্রহী নন। তিনি এখন দল নিয়ে তিনি এগোতে চান।”

গণফোরাম ১ অগাস্ট থেকে সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করবে এবং জেলা পর্যায়ে সাংগঠনিক সফর ও কর্মিসভাও করবে।

গণফোরামের যুগ্ম সম্পাদক আমিন আহমেদ আফসারী জানিয়েছেন, তারা কুড়িগ্রামে ত্রাণ তৎপরতাও চালাচ্ছেন।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না সংসদে যোগদান প্রশ্নে তখনই বিএনপিকে নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছিলেন।

গত ৩০ এপ্রিল তিনি এক প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব ফখরুলকে বলেছিলেন, “যদি সমঝোতা হয় তা হলে সেই সমঝোতাটা খোলাখুলি বলেন, কী সমঝোতা হয়েছে?”