প্রিয়া সাহা: ‘মশা মারতে কামান দাগাতে চান না’ কাদের

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ করে আলোচিত প্রিয়া সাহার বিষয়ে তড়িঘড়ি কিছু করতে রাজি নন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। 

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 July 2019, 09:08 AM
Updated : 22 July 2019, 11:10 AM

সোমবার সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এ ধরনের বক্তব্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে বলা, এটা আমাদের দেশকে ছোট করা। এটা একটা কাল্পনিক বক্তব্য, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বক্তব্য। আমরা রয়ে সয়ে অগ্রসর হচ্ছি, মশা মারতে আমরা কামান দাগাতে চাই না।”

প্রিয়া সাহা দেশে না ফিরলে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না- তা সেতুমন্ত্রী কাদেরের কাছে জানতে চেয়েছিলেন সাংবাদিকরা।

উত্তরে তিনি বলেন, “উনি নিজেই বলেছেন দেশে ফিরে আসবেন। আর এটা এমন একটা বিষয় নয় যে জোর করে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে, এরকম কিছু আমরা পাইনি। আমরা খতিয়ে দেখছি, সেরকম কিছু হলে পরে দেখা যাবে।”

দলিত সম্প্রদায় নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা‘শারি’র পরিচালক প্রিয়া সাহা বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক। ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে ওয়াশিংটনে আয়োজিত এক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে গত ১৭ জুলাই হোয়াইট হাউজে যান তিনি।

সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌলবাদীদের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নিখোঁজ (ডিজঅ্যাপিয়ার্ড) হয়েছেন। তারা যেন দেশে থাকতে পারেন, সেজন্য ট্রাম্প যেন সহায়তা করেন।

তার ওই বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় বিভিন্ন মহলে।

সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ‘ক্ষুণ্নের উদ্দেশ্যেই’ প্রিয়া সাহা ওই ধরনের ‘বানোয়াট ও কল্পিত অভিযোগ’ করেছেন। দেশে ফিরলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলেও ঘোষণা দেন একজন মন্ত্রী।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শনিবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ওই বক্তব্য দিয়ে প্রিয়া সাহা ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ’ করেছেন।

তবে রোববার তিনি জানান, প্রিয়া সাহার ব্যাখ্যা শোনার আগে তড়িঘড়ি কোনো আইনি ব্যবস্থা না নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়েছেন তিনি।

এরপর একজন সাংবাদিককে প্রিয়ার সাক্ষাৎকার দেওয়ার একটি ভিডিও রোববার তার এনজিও শারির ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশ করা হয়; সেখানে তিনি নিজের বক্তব্যের একটি ব্যাখ্যা দেন।

প্রিয়া সাহা দাবি করেন, ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের নিখোঁজ হওয়ার যে ‘তথ্য’ তিনি প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে দিয়েছেন,তা সরকারি পরিসংখ্যান থেকেই নেওয়া। অধ্যাপক আবুল বারকাত ওই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ২০১১ সালে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন, যা সে সময় গণমাধ্যমেও আসে।

আর ট্রাম্পের কাছে বিষয়টি তোলার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে অভিন্ন অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র সরকার যাতে ‘একসঙ্গে কাজ করতে পারে’- সেজন্যই তিনি হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সহযোগিতা চেয়েছেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা তার উদ্দেশ্য ছিল না।

প্রিয়া বলেন, “এই কথাগুলো তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা। ২০০১ সালে যখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্বাচনোত্তর চরম নির্যাতন চলছিল ৯৪ দিন ধরে, আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখন বিরোধী দলীয় নেত্রী। তিনি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার জন্য সারা পৃথিবীতে ঘুরেছেন। সমস্ত জায়গায় বক্তব্য দিয়েছেন।

“তার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে, তার অনুসরণে আমি বলেছি। যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনো জায়গায় বলা যায়- এটা আমি তার কাছে শিখেছি।”

তবে তার ওই ব্যাখ্যার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, “শেখ হাসিনার বক্তব্যে তিন কোটি ৭০ লাখ লোক মিসিং- এ কথা তো কোথাও নাই।“

প্রিয়া সাহার এসব বক্তব্য দেওয়ার পেছনে ‘অন্য কারো হাত’ আছে কিনা সরকার তা খতিয়ে দেখছে জানিয়ে কাদের বলেন, “তিনি যখন দেশে ফিরবেন, তিনি বলেছেন দেশে ফিরবেন, তখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে যে তিনি কী উদ্দেশ্যে বলেছেন, কেন বলেছেন, কী ইনফরমেশনের ভিত্তিতে বলেছেন- সেটা তাকে অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে।”

বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়ার ওই বক্তব্যে সারা দেশে ‘বিভ্রান্তি’ তৈরি হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন ওবায়দুল কাদের।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ থেকে তিন কোটি ৭০ লাখ মাইনরিটি মানুষ- এ ধরনের উদ্ভট-কাল্পনিক বক্তব্য উনি কেন দিলেন, কেমন করে দিলেন? আর শেখ হাসিনা মাইনরিটি নিয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন সে বক্তব্যের সাথে সংখ্যাতত্ত্বের ওই বিষয়টারতো কোনো মিল নেই।”

প্রিয়া সাহার স্বামী যে দুদকের একজন কর্মকর্তা- সে বিষয়ে একজন সাংবাদিক সেতুমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

কাদের তখন বলেন, “উনার স্বামী সরকারি চাকরি করে। এক পরিবারে স্বামী-স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে সবাই এক মতাবলম্বী হবেন- এমন তো কোন কথা নেই। উনার স্ত্রী অন্যায় করল, সেটার জন্য স্বামীকে কেন অভিযুক্ত করতে হবে? এটা তো কোনো আইনে নেই। আমরা অহেতুক এ ধরনের বিষয়েকে কেন ইনভাইট করতে যাব?”

প্রিয়া সাহার বিষয়ে সরকার পিছু হটছে কিনা- এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে কাদের বলেন, “এটা ব্যাকফুটের কোনো বিষয় না। বিষয়টা হলো কমিউনাল কলিশন সৃষ্টির বিষয়। কারণ, সে সামান্য ব্যক্তি হলেও তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

“উনি এনজিও সংগঠনের নেতৃত্ব দেন, আবার হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের অ্যাপেক্স বডির অর্গানাইজিং সেক্রেটারি। কাজেই এটাকে তো তুচ্ছ জ্ঞান আমরা করতে পারি না। বিষয়টার গভীরে আমরা যাচ্ছি, সব কিছু জেনেশুনে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে চাই।”

প্রিয়া সাহার বক্তব্যের পেছনে কাদের প্ররোচনা থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন- এমন প্রশ্নও রাখা হয়েছিল ওবায়দুল কাদেরের সামনে।

জবাবে তিনি বলেন, “শেখানো কথা কিনা- সেটা আমাদের জানা নেই। কারো প্ররোচণা করেছে কিনা, পেছনে কোনো রাজনৈতিক মতলব আছে কিনা, উসকানি আছে কিনা, বিষয়টা আমাদের জানতে হবে এবং আমরা বিষয়টা খতিয়ে দেখছি।”

ছেলে ধরা আতঙ্ক

ছেলে ধরা আতঙ্কে দেশের বিভিন্ন স্থানে পিটিয়ে হত্যার যেসব ঘটনা ঘটছে- সে বিষয়েও সেতুমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সাংবাদিকরা।

কাদের বলেন, “এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তারা বিষয়টির পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন, এটাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে জানিয়েছেন।”

এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জড়িত থাকলে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে ‘আপসহীন’ থাকার প্রতিশ্রুতি দেন দলের সাধারণ সম্পাদক।

তিনি বলেন, “সবার ক্ষেত্রে একই রকমের আইন প্রযোজ্য হবে, একই রকমের ব্যবস্থা প্রযোজ্য হবে, দলীয় লোকের জন্য আলাদা ব্যবস্থা শেখ হাসিনার সরকার কখনও করেনি, এখনও করে না, ভবিষ্যতেও করবে না।”

বিআরটিসির বকেয়া বেতন

বকেয়া আদায়ে বিআরটিসি শ্রমিকদের অফিস ঘেরাও প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী বলেন, “এটা সব জায়গায় নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়েছে। বিআরটিসিতে চেয়ারম্যান পরিবর্তন এসেছে, নতুন চেয়ারম্যান যোগ দিচ্ছে।

“কিছু কিছু বিশৃঙ্খলার অভিযোগ আছে, যেগুলো মন্ত্রণালয় থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসাররা দেখছেন। বেতনের ব্যাপারটা লার্জ স্কেলে নেই। দুয়েকটা জায়গায় আছে সেটা আমরা খতিয়ে দেখছি এবং ব্যবস্থা নিচ্ছি।