বাকি ছিল শুধু মঞ্জুর হত্যা মামলা

গত তিন দশকে ৪২টি মামলার দায় থেকে মুক্ত হতে পারলেও একটি হত্যা মামলার আসামি হয়েই চিরবিদায় নিলেন সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাস আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 July 2019, 06:15 AM
Updated : 28 Sept 2019, 09:13 AM

মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর হত্যা মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তার সর্বোচ্চ সাজার রায় আসতে পারত; যদিও তিনি সব সময় ওই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন।

ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার সকালে মারা যান সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ।

তার ভাষায়, ৯০ বছরের জীবনের শেষে ২৯টি বছরে একটি দিনও তিনি সুখী ছিলেন না। আর তার ওই অসুখের কারণ ছিল দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে দায়ের করা সাড়ে তিন ডজন মামলা। 

গত বছর ২০ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেন, “এখনও আমার নামে মামলা আছে। আমার মত দুঃখী কেউ নেই। পার্টির জন্য আমার চেয়ে কষ্ট কেউ করেনি।”

১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মুখে রাষ্ট্রপতি এরশাদের পতনের পর বিভিন্ন অভিযোগে মোট ৪৩টি মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। এর তিনটিতে নিম্ন আদালতে তার সাজার আদেশ হলেও হাই কোর্টে একটিতে খালাস পান। বাকি দুই মামলায় তিনি সাজা খাটা শেষ করেন। 

রাষ্ট্রপতি থাকাকালে পাওয়া উপহার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে আর্থিক অনিয়মের মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত এরশাদকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়। দুই যুগ পর হাই কোর্ট সেই সাজা বাতিল করে এরশাদকে খালাস দেয়।

জাপানি নৌযান কেনায় অনিয়মের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় প্রথমে এরশাদের তিন বছর এবং পরে হাই কোর্টে আপিলে সাজা কমে দুই বছরের কারাদণ্ড হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই বছর কারাগারে কাটানোয় এরশাদকে নতুন করে আর ওই মামলায় দণ্ড ভোগ করতে হয়নি।

জনতা টাওয়ার দুর্নীতি মামলায় নিম্ন আদালত এরশাদকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল। ১৭ বছর পর হাই কোর্ট সাজা কমিয়ে এরশাদকে ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫ কোটি ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করে।

হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল চলাকালে এরশাদের সাড়ে ৩ বছর কারাভোগ শেষ হওয়ায় আপিল বিভাগ পরে জরিমানার দণ্ড বহাল রেখে এরশাদকে অবশিষ্ট দেড় বছর সাজাভোগ থেকে অব্যাহতি দেয়।

এছাড়া স্বর্ণ চোরাচালান, টেলিকম দুর্নীতি, পোল্ট্রি ফার্ম দুর্নীতি মামলা, আয়কর ফাঁকি, জাহাজ কেনায় দুর্নীতি, রাজউকের প্লট বরাদ্দে অনিয়ম, হরিপুরে তেল অনুসন্ধানে দুর্নীতি এবং রাডার কেনায় দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে আরও ১৯টি মামলা ছিল এরশাদের বিরুদ্ধে।  

এর মধ্যে কয়েকটিতে তিনি নিম্ন আদালত থেকে বেকসুর খালাস পান। কয়েকটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

কিন্তু ৩৮ বছর আগে সেনাবাহিনীর মেজর মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুর হত্যা মামলা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এরশাদের গলার কাঁটা হয়েই ছিল।

মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর

১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় চট্টগ্রামে একদল সৈন্যের গুলিতে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ওই ঘটনার পর পুলিশের হাতে আটক হন জেনারেল মঞ্জুর, যিনি সে সময় সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ছিলেন। পুলিশ হেফাজত থেকে ১ জুন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নেওয়ার পর তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তখন এরশাদ ছিলেন সেনাপ্রধানের দায়িত্বে। পরে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন।

গণআন্দোলনে এরশাদের পতন ঘটলে ঘটনার ১৪ বছর পর ১৯৯৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন মঞ্জুরের ভাই। ওই বছরই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তখনকার সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ অভিযোগপত্র দেন এবং বিচার শুরু করে আদালত।

তবে সরকার বদল এবং রাষ্ট্রপক্ষের গড়িমসিতে এ মামলার বিচারকাজ বিলম্বিত হতে থাকে বার বার।

মামলার শুনানির সময় আত্মপক্ষ সমর্থনে এরশাদ বলেন, জেনারেল মঞ্জুরকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তৎকালীন সরকার রেডিও টিভিতে ৫ লাখ টাকা ঘোষণা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। তবে ওই ঘটনার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না।

“ধরা পড়ার পর মেজর মঞ্জুরকে  চট্টগ্রাম সেনানিবাসে আনার পথে বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা তাকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে এবং পরে নিরাপত্তা প্রহরীর সঙ্গে গুলি বিনিময় হয়। একপর্যায়ে আবুল মঞ্জুর গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। পরে হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান।”

তখনকার স্বরাষ্ট্র সচিব মাহবুবুজ্জামান এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দিতে বলেন, তখনকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নির্দেশে পুলিশ আবুল মঞ্জুরকে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে।

২০১২ সালের ২ অক্টোবর  নাজিমউদ্দিন রোডের বিশেষ এজলাসে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত দায়রা জজের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থন করে লিখিত বক্তব্য দাখিল করেন এরশাদ।

তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দ, সাবেক সেনাপ্রধান আবু সালেহ মো. নাসিম এবং তৎকালীন মহানগর হাকিম আবুল হাসেমসহ রাষ্ট্রপক্ষে মোট ২৮ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে।

২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি মামলার ২৩তম বিচারক ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হোসনে আরা আক্তার আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য ওই বছর ১০ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করে দেন। কিন্তু এক সপ্তাহের মাথায় বিচারকের বদলির আদেশ আসে।

তার জায়গায় নতুন বিচারক হিসাবে যোগ দেন খন্দকার হাসান মাহমুদ ফিরোজ। রায় দেওয়ার আগে তিনি নতুন করে যুক্তিতর্ক শুনতে চান। সেজন্য ২৭ ফেব্রুয়ারি দিন ঠিক করে দেন। 

কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পিপি) আসাদুজ্জামান খান রচি সেদিন এ মামলায় অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে বিচারিক তা মঞ্জুর করেন।

এরপর দফায় দফায় সময় বাড়ানো হলেও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন আর জমা দিতে পারেনি।

জাপা নেতাদের অভিযোগ, এরশাদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার হয়েছে

সর্বশেষ চলতি বছরের ২৭ জুন নাজিমুদ্দিন রোডের পুরান কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক শরীফ এ এম রেজা জাকের অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২৬ অগাস্ট দিন ঠিক করে দেন। তার আগেই মামলার প্রধান আসামির মৃত্যু ঘটল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাকি সব মামলা থেকে এরশাদ একে একে মুক্ত হলেও মঞ্জুর হত্যা মামলা এরশাদকে আটকে রেখেছিল রাজনৈতিক জটিলতার মধ্যে। জোট আর ভোটের রাজনীতিতে এরশাদকে ‘বশে রাখতে’ এ মামলাটিকে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ ছিল জাতীয় পার্টির নেতাদের।   

এরশাদের প্রধান আইনজীবী শেখ সিরাজুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এরশাদের বিরুদ্ধে শুধু এ মামলাটিই নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ছিল। বাকি ৪২টি মামলার নিষ্পত্তি আগেই হয়ে গেছে।

“এ মামলায় এজাহারে এরশাদের নাম ছিল না, পরে তার নাম যুক্ত করা হয়। মামলার বিচারে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো সাক্ষীই ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার কথা বলেন নাই । আমাদের বিশ্বাস, আইন স্বাভাবিক গতিতে চললে এ মামলাতেও তিনি খালাস পেতেন।”

এরশাদ ছাড়াও মেজর (অব.) কাজী এমদাদুল হক ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মোস্তফা কামাল উদ্দিন ভূইঞা, মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল লতিফ এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) শামসুর রহমান শমসেরের নাম রয়েছে এ মামলায় আসামির তালিকায়। তবে শেষ দুইজনের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে।