সোনার বাংলাদেশ গড়ার প্রতিজ্ঞা আ. লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে

বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা নিয়ে আওয়ামী লীগ কাজ করে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 June 2019, 05:20 AM
Updated : 23 June 2019, 09:04 AM

রোববার সকালে দলের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে স্থাপিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর পর একথা বলেন তিনি।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে; সারা বিশ্বে বাঙালি জাতি মর্যাদা অর্জন করেছে। কাজেই আওয়ামী লীগই দেশকে দেয়, মানুষকে দেয়। সেই সম্মান আমরা ফিরিয়ে দিয়েছি। বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, সোনার বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করব- আজকের দিনে এটা আমাদের প্রতিজ্ঞা।”

সকাল সাড়ে ৮টার দিকে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। পরে দলের সভানেত্রী হিসেবে দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে শ্রদ্ধা জানান তিনি।

শ্রদ্ধা নিবেদনের পর জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন শেখ হাসিনা। এ সময় পায়রা ও বেলুন ওড়ানো হয়।

পরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের ভেতরে গিয়ে কিছু সময় অবস্থান করেন।

প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর একে একে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতারাও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

আওয়ামী লীগের পথচলা

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আত্মপ্রকাশ ঘটে আওয়ামী লীগের। প্রায় দুই যুগ পর যে দলটির নেতৃত্বে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।

মুসলিম লীগের প্রগতিশীল একটি অংশের উদ্যোগে বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।

প্রতিষ্ঠাকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দলটির সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।

পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রোজ গার্ডেনের বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল।”

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতারা সেদিন রোজ গার্ডেনে উপস্থিত ছিলেন।

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল- ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’।

“আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে।”

১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার 'মুকুল' প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিব।

আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে যাত্রা শুরু করলেও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ১৯৫৫ সালের কাউন্সিলে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। নতুন নাম হয়-‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নাম নেয় দলটি।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাজনৈতিক সংগ্রাম, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়সহ বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে ৫০ এর দশকেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি।

তবে প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি আব্দুল হামিদ খান ভাসানী রাজনৈতিক মতভিন্নতার জন্য ১৯৫৭ সালে দল ছেড়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ।

শুরুর দিকে দলটির প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি, এক ব্যক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দু'অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ।

১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে আওয়ামী মুসলীম লীগ।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অন্যান্য দলকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে আওয়ামী মুসলিম লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

ওই বছরের মার্চের আট থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি  আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়। এরমধ্যে, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ পেয়েছিল ১৪৩টি আসন।

২৪ বছরের পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী মুসলিম লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দু'বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল।

পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫৭ সালে দলে ভাঙন দেখা দেয়। ওই বছরের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারি সম্মেলনে দলে বিভক্তির ঘটনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় মাওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।

এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘসময় এই দলটি সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করে জনগণের মধ্যে আস্থার স্থান তৈরি করে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দেন বঙ্গবন্ধু, যাকে বাঙালির মুক্তির সনদ নামে অভিহিত করা হয়। ছয় দফার ভিত্তিতেই ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।

এরপর পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যূদয় ঘটে বাংলাদেশের।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর কারাগারের অভ্যন্তরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর সামরিক শাসনের নির্যাতন আর নিপীড়নের মধ্যে পড়ে ঐতিহ্যবাহী এই সংগঠনটি। নেতাদের মধ্যেও দেখা দেয় বিভেদ।

১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলীয় সভাপতি হিসাবে দেশে ফিরে কয়েক ভাগে বিভক্ত আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করেন, আন্দোলন শুরু করেন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের বিরুদ্ধে।

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। পাঁচ বছর শাসনের পর ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। কিন্তু দলটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, কারচুপির মাধ্যমে তাদের হারানো হয়েছে।

পরবর্তীতে দেশে রাজনৈতিক সঙ্কটের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে পুনরায় সরকার গঠন করে। আর ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালে দেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা ধরে রাখে আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে টানা তিনবার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।