বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জায়গা নেই: কামাল

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতা গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশে কখনও স্বৈরতন্ত্রের স্থান হবে না।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 May 2019, 05:33 PM
Updated : 13 May 2019, 05:33 PM

প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহর স্মরণে সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত এক এক নাগরিক সভায় একথা বলেন তিনি।

কামাল বলেন, “এই দেশে স্বৈরাচার অনেকবার চেষ্টা করেছে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে চিরস্থায়ী হতে। কেউ কিন্তু পারে নাই।

“আমার অভিজ্ঞতার আলোকে আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট গ্যারেন্টি দিতে পারি, বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের কোনো জায়গা নাই। স্বৈরতন্ত্র যতই মনে করে টাকা দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে বিভিন্ন রকমের প্রভাব খাটিয়ে, তারা চিরস্থায়ী হতে পারবে, তারা আহম্মকের স্বর্গে বাস করে।”

বিএনপিকে নিয়ে গঠিত ঐক্যফ্রন্টের নেতারা দাবি করে আসছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ চালাচ্ছে।

সভায় ঐক্যফ্রন্টের শরিক জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, “দেশে গণতন্ত্র নেই, আইন নেই, মূল্যবোধ নেই। কোনো বিচার হচ্ছে না, দীর্ঘসূত্রতা। এ কী অরাজকতা!

“বাংলাদেশের গণতন্ত্র উদ্ধার ঐক্য ছাড়া হবে না, স্বৈরতন্ত্রের বিদায় ঐক্য ছাড়া হবে না, ফ্যাসিবাদের অবসান ঐক্য ছাড়া হবে না। জনগণের আকাঙ্ক্ষা এই ঐক্য।”

মাহফুজউল্লাহ বলতেন ‘সাহস নিয়ে’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় অধিকাংশ বক্তাই সাংবাদিক-বিশ্লেষক মাহফুজউল্লাহর দৃঢ়চেতা মনোভাবের কথা স্মরণ করেন।

থাইল্যান্ডের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৮ এপ্রিল মারা যান মাহফুজউল্লাহ। তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। নানা সংগঠনে বিভক্ত সাংবাদিকদের সবাই তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন।

জাতীয় প্রেস ক্লাবে সোমবার অনুষ্ঠিত সভায় সাংবাদিকদের বিভক্ত অংশগুলোর নেতাদের পাশাপাশি রাজনীতির ময়দানে বিরোধী অবস্থানে থাকা নেতারাও এক হয়েছিলেন।

গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেন ষাটের দশকে মাহফুজউল্লাহর সঙ্গে পরিচয়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আজকে সব মহলের লোক এখানে একত্রিত হয়েছেন, উনাকে (মাহফুজউল্লাহ) সন্মান জানাচ্ছেন। কেন?

“উনি ঝুঁকি নিয়েছিলেন, সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন, যখন উচিৎ কথা বলা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, তখনও। আজকেও ঝুঁকিপূর্ণ আছে।”

ক্ষমতাসীন জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন তার নেতৃত্বাধীন সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হিসেবে মাহফুজউল্লাহকে স্মরণ করেন।

তিনি আরও বলেন, “তার অনেক বই আছে, অনেক লেখা আছে। তবে আমি বলব, একটি বইয়ের জন্য সে চিরজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তা হচ্ছে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ইউনিয়নের ইতিহাস’।

“সাংবাদিক হিসেবেও পরিবেশ সাংবাদিকতার যে জায়গাটি হাতে নিয়েছিলেন সেটা আমাদেরকে পরিবেশ সম্পর্কে বুঝতে সহায়তা করেছে এবং আমাদেরকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে।”

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নুহ উল আলম লেলিন বলেন, “মাহফুজউল্লাহ ও আমি বলা যেতে পারে একই লক্ষ্যে দুই পথের যাত্রী। রাজনৈতিকভাবে আমরা দুই মেরুর মানুষ। আমি ছিলাম মতিয়া গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়নে, সে ছিল মেনন গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়নে। আমি স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হয়েছি। সেও আরেক ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হয়েছে।

“আমি আওয়ামী লীগ করে এখনও করছি, সে বিএনপির ধারার সাথে যুক্ত হয়েছিল। তার সাথে আমি দুই মেরুতে থেকেও শেষের দিনগুলোতে টক শোতে প্রায়শ একসাথে বসতাম, কেউ কাউকে ছাড় দিতাম না। কিন্তু কোনো দিন আমাদের মধ্যে কোনো অশালীন, অশুভ বা উত্তেজনা সৃষ্টি হত না।”

মাহফুজউল্লাহর সঙ্গে যুক্তি লড়াই চালানোর কথা জানিয়ে লেনিন বলেন, “আজকের সমাজে মতপার্থক্য হলেই কথা নাই, বার্তা নাই! যে একটা বৈরী সংস্কৃতি চলছে, সেটা আমাদের মধ্যে ছিল না।”

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আবেগআপ্লুত কণ্ঠে বলেন, “তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ ছিল যে আমি কখনও ভাবিনি সে আমার পাশে থাকবে না।

“কিছুদিন আগে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সের একটি সভায় মাহফুজউল্লাহ এসেছিলেন, আমাদের অনেক নেতৃবৃন্দ ছিলেন। সেখানে তিনি বিএনপির কঠিন সমালোচনা করেছিলেন। এটাই ছিল তার বড় গুণ। সত্যকে সত্য বলতে কখনও সে দ্বিধা করেনি।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “বিশিষ্ট ব্যাক্তিরা আজকে মুখ খুলতে সাহস পান না। তার মধ্যেও মাহফুজউল্লাহ গণতন্ত্র, মুক্ত চিন্তার চর্চার অধিকারের জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন।”

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “যে কয়টা টকশোতে আমি তার সঙ্গে ছিলাম, আমার সবচাইতে ভালো লেগেছে এটা দেখে যে, নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসকে ধারণ করবার পরও অন্যের বিশ্বাসের প্রতি সন্মান দেখাবার অপরিসীম ভালোবাসা।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, “মাহফুজউল্লাহ ভাই কোনো দলের অনুগত ছিলেন না। এই সরকারের আমলে গত ১০ বছরে যারা ভিন্ন মতাবলম্বী আছেন, তাদের কাউকে কাউকে বিদেশে চলে যেতে হয়েছে কেউ কেউ জেলে গিয়েছেন, কেউ কেউ কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন। সব কিছুর মধ্যে উনি একা অবিচলভাবে একটা ভারসাম্যমূলক কথা বলে গেছেন।”

সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেন, “মাহফুজউল্লাহ একজন স্পষ্টবাদী সাংবাদিক ছিলেন। গবেষণাধর্মী মন ও অনুসন্ধানীমূলক সাংবাদিকতার আগ্রহ ছিল তার। তার কর্মের জন্য সবাই তাকে স্মরণে রাখবে।”

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, “এটা স্বীকার করতেই হবে তিনি (মাহফুজউল্লাহ) মেরুদণ্ডটা সোজা করে হাঁটতেন। তিনি যা চিন্তা করতেন, যা ভাবতেন, অকপটে তা বলতেন। সত্যকে সত্য বলার, মেরুদণ্ড সোজা করে হাঁটবার মতো সাংবাদিক একদম কম।”

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, “মাহফুজউল্লাহর সাহসিকতা, সদাচারিতা, সুস্পষ্টবাদী চিন্তাভাবনা বক্তব্য উপস্থাপনার সক্ষমতা- এই গুণগুলো আমাদের তরুণদের আয়ত্তে আসুক, এই আশা রাখছি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌসের পরিচালনায় এই নাগরিক সভায় ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব সা‘দাত হুসেন, গণস্বাস্থ্য সংস্থার ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরীও বক্তব্য রাখেন।

সভায় সূচনা বক্তব্য রাখেন মাহফুজউল্লাহ বড় ভাই অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ। প্রয়াতের মেয়ে নুসরাত হুমায়রাও বক্তব্য রাখেন।

এছাড়াও বক্তব্য রাখেন বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার, কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মুহাম্মদ জমির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সদরুল আমিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, নিউজ এইজ সম্পাদক নুরুল কবির, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ।