সিদ্ধান্ত হঠাৎ বদলে সংসদে বিএনপি

একাদশ সংসদ নির্বাচনে ‘ভোট ডাকাতি’র অভিযোগ তোলার পর সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিয়েছিল বিএনপি।

সুমন মাহমুদও সাজিদুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 April 2019, 11:45 AM
Updated : 29 April 2019, 04:15 PM

জোটভুক্ত দল গণফোরামের দুজন শপথ নেওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ করেছিল দলটি।

তিন দিন আগেও আগের সিদ্ধান্তে অটল থাকার কথাই জানিয়েছিল বিএনপি; সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেওয়ায় দল থেকে জাহিদুর রহমান জাহিদকে বহিষ্কারও করেছিল।

সোমবার দুপুরে বিএনপির চারজন সংসদ সদস্যের শপথ নেওয়া গুঞ্জন যখন ছড়িয়ে পড়েছিল, তখনও দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সংবাদ সম্মেলন ডেকে আগের সিদ্ধান্তের কথাই বলছিলেন।

এমনকি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সভায় বলেছিলেন, “এখন যে সরকার আছে, এই সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার নয়।”

তারপর বিকালে শপথ নিয়ে হারুনুর রশীদ যখন দাবি করেন যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্মতিতেই শপথ নিয়েছেন তারা, তখন শুরু হয় নতুন আলোচনা।

কিন্তু রাতে জরুরি এক সংবাদ সম্মেলনে এসে ফখরুল নিশ্চিত করেন, তারেকের নির্দেশেই সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছেন।

শপথ নেওয়ার পর রাতে সংসদ অধিবেশনেও যোগ দেন বিএনপি থেকে নির্বাচিত পাঁচজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উকিল আব্দুস সাত্তার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের হারুনুর রশীদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের আমিনুল ইসলাম, বগুড়া-৪ আসনের মোশাররফ হোসেন এবং ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের জাহিদুর রহমান জাহিদ।

এই পাঁচজনের অধিবেশন কক্ষে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে আইনসভায় পাঁচ বছর পর ফিরল খালেদা জিয়ার দল। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের পর দশম সংসদে থাকার সুযোগ হয়নি দলটির।

একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে বিএনপি থেকে মাত্র ছয়জন বিজয়ী হয়েছেন; তার মধ্যে পাঁচজন শপথ নিলেও বগুড়া-৬ আসনে বিজয়ী ফখরুল এখনও নেননি।

অধিবেশন বসার ৯০ দিনের মধ্যে শপথ না নিলে তার আসন হারানোর ঝুঁকি রয়েছে। গত ২৯ জানুয়ারি এই সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হওয়ায় ৯০ দিনের সেই সময়সীমা অতিক্রান্ত হচ্ছে সোমবারই।

দলের সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে একাই এসেছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগঅর

নিজের শপথের বিষয়ে ফখরুল সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেন, “সময় মতোই আপনারা জানতে পারবেন।”

২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জনের পর ভোট ঠেকানোর ঘোষণা দিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল বিএনপি; পরের বছর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে টানা অবরোধ ডেকেছিলেন দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিন মাসের অবরোধেও সফল না হওয়ার পর কর্মসূচি গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল দলটি।

এরপর তারা বলেছিল, নির্দলীয় সরকারের অধীনে না হলে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। গত বছর দুর্নীতির মামলায় দণ্ড নিয়ে খালেদা জিয়া কারাগারে গেলে তারা আরও জোর গলায় বলেছিল, দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তি না হলে ভোটে তারা যাবে না। 

কিন্তু একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডাকা সংলাপে অংশ নেওয়ার পর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আসে দলটি, ভোটের লড়াইয়ে কামাল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে জোট গড়ে আশায় বুক বাঁধে।

কিন্তু ওই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জেতে মাত্র আটটি আসনে, এর মধ্যে ছয়টিতে বিএনপি এবং দুটিতে গণফোরাম।

শোচনীয় হারের পর পুনর্নির্বাচনের দাবি তোলা হয় বিএনপি এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে। তারা বলে, এই ‘অবৈধ’ সরকার ও সংসদকে বৈধতা দিতে তারা সংসদে যাবেন না।

কিন্তু এর মধ্যেই গণফোরামের দুজন সুলতান মো. মনসুর আহমেদ ও মোকাব্বির খান শপথ নিয়ে ফেললে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ তোলেন বিএনপি নেতারা। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করায় সুলতান মনসুরকে বহিষ্কারও করে গণফোরাম; মোকাব্বিরের বিরুদ্ধেও নেওয়া হয় পদক্ষেপ।

তারপর আকস্মিকভাবে গত বৃহস্পতিবার শপথ নিতে যান ফখরুলের জেলা ঠাকুরগাঁও থেকে ধানের শীষে নির্বাচিত জাহিদ; অন্যদের কঠোর বার্তা দিতে তাকে ওই দিনই বহিষ্কার করে বিএনপি।

বিএনপির সংসদ সদস্যদের শপথ নিতে সরকার চাপ দিচ্ছে বলে দলটির নেতারা অভিযোগ করলেও জাহিদ বলেছিলেন, নির্বাচনী এলাকার মানুষের চাপে তিনি সংসদে যেতে চান।

জাহিদের পর বিএনপির অন্যদের শপথ নেওয়ার গুঞ্জন শুরু হয়; যদিও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দলটির নেতারা শপথ নেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছিলেন।

সোমবার যখন চারজনের শপথ নেওয়ার গুঞ্জন ব্যাপক আকারে ছড়ায়, তখন নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে কয়েক নেতাকে সঙ্গে নিয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আসেন রিজভী।

বিএনপি থেকে নির্বাচিতদের শপথ নিতে সরকার চাপ দিচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, “এমপি ভাগিয়ে নিয়ে বৈধতা নেওয়ার অপচেষ্টা করে বৈধতা পাওয়া যাবে না।”

ওই সময় জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক প্রতিবাদ সমাবেশে ছিলেন মহাসচিব ফখরুল; তখনও তার মুখ থেকে কোনো ইঙ্গিত মেলেনি।

সোমবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বৃহত্তর ময়মনসিংহ ফোরামের আলোচনা সভায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

দুপুরে হারুন সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসায় বলেন, এলাকার মানুষ তাদের শপথ নিতে চাপ দিচ্ছে, তারা এখন দলের সিদ্ধান্ত জানার অপেক্ষায় আছেন।

এরপর বিকালে সংসদ ভবনে স্পিকারের কার্যালয়ে উপস্থিত হন উকিল আবদুস সাত্তার, হারুন, মোশাররফ ও আমিনুল।

তার আগে বিকাল ৩টার দিকে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী সংসদ ভবনে আসার কিছু সময় পর তার কার্যালয়ে শপথ অনুষ্ঠানের তোড়জোড় দেখা গেলেও সাংবাদিকদের কিছুই জানানো হয়নি।

বিকাল ৫টায় শিরীন শারমিনের সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়। তার কিছু সময় পর বিএনপির চারজনও ঢোকেন সেখানে। এরপর স্পিকার অধিবেশন থেকে তার কক্ষে ফিরে তাদের শপথ পড়ান।

সংসদের প্রধান হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন, হুইপ ইকবালুর রহিম এসময় উপস্থিত ছিলেন। তিন দিন আগে শপথ নেওয়া জাহিদ এবং হারুনের স্ত্রী সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দা আসিফা আশরাফী পাপিয়াও ছিলেন সেখানে।

শপথ শেষে নিরাপত্তাকর্মীরা বিএনপির চার সংসদ সদস্যকে সংসদ সচিবের কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে রীতি অনুযায়ী স্বাক্ষর বইতে সই করেন তারা।

শপথ নেওয়ার আগে সংসদ ভবনে স্পিকারের কক্ষে (বাঁ থেকে) হারুনুর রশীদ, মোশাররফ হোসেন, উকিল আবদুস সাত্তার ও আমিনুল ইসলাম- ছবি: সাজিদুল হক

চারজন শপথ নিয়ে ফেলার পর বিএনপির পক্ষ থেকে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে মির্জা ফখরুলের জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকার কথা জানানো হয়।

রাতে একাই সেই সংবাদ সম্মেলনে আসেন ফখরুল; তিনি বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।

কেন এই সিদ্ধান্ত বদল- তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সংসদে কথা বলার সীমিত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংসদ ও রাজপথের সংগ্রামকে যুগপৎভাবে চালিয়ে যাওয়াকে আমরা যুক্তিযুক্ত মনে করছি।

“জাতীয় রাজনীতির এই সংকটময় জটিল প্রেক্ষিতে দেশনেত্রীর সুচিকিৎসা, মুক্তি এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের অংশ হিসেবে আমাদের দল সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তির বিনিময়ে বিএনপি সংসদে যোগ দিতে যাচ্ছে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা রয়েছে; যদিও বিএনপি নেতারা বলছিলেন, কোনো শর্তে দলীয় নেত্রীর মুক্তি চান না তারা। 

তবে সোমবার দুপুরের আলোচনা অনুষ্ঠানে ফখরুল বলেছিলেন, “দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অনেক কষ্টে আছেন। তিনি প্রায় ১৪ মাসের উপরে কারাগারে আছেন, তিনি অত্যন্ত অসুস্থ, যা আমি বর্ণনা করতে পারব না।

“আমি নিজে দেখেছি তাকে। তিনি এখন নিজে বিছানা থেকে উঠতে পারেন না, তাকে সাহায্য করতে হয়। তিনি হাঁটতে পারেন না, হুইল চেয়ারে চলতে হয়, খেতে পারেন না, তার শরীর একদম ভালো নেই।”

অসুস্থ খালেদা জিয়াকে গত ১ এপ্রিল বিএসএমএমইউতেও হুইল চেয়ারে চলতে দেখা গিয়েছিল

সেক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতা হয়েছে কি না- সংবাদ সম্মেলনে এই প্রশ্নে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “সমঝোতার প্রশ্ন কোথায় দেখলেন আপনারা?

“আমরা বলছি যে, সংসদের ভেতরে ও বাইরে দুইখানে আমরা এই দাবিটা করে যেতে চাই। সংসদ একটা জায়গা, যেখানে একটা স্পেস আছে টিল টুডে। যেখানে কিছু কথা বলা যায়। সেই কথা বলার জন্য আমাদের যারা নির্বাচিত তারা শপথ নিয়েছেন।”

সরকারের চাপে শপথ নেওয়ার এই সিদ্ধান্ত নেননি বলে দাবি করেন ফখরুল।

রিজভী যে চাপের কথা তুলেছেন, তা বলা হলে তিনি বলেন, “সেটা শপথ গ্রহণের আগের বক্তব্য ছিল।”

তাহলে কি আপনাদের উপর কোনো চাপ নেই- এই প্রশ্নে ফখরুল বলেন, “আমরা মহাচাপে আছি। গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই, আমাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না। এই চাপ তো আছেই। আমাদের নেত্রী জেলে। এসব সরকারের চাপ নয় কি?”

তাহলে কি নির্বাচনকে বৈধতা দিচ্ছেন- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “নির্বাচনের বৈধতা দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। আমরা স্পষ্ট করে বলেছি যে, আমাদের কথা বলার সীমিত যে সুযোগ আছে, তার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে সংসদে যাচ্ছি।

“আমরা এই সংসদও বৈধতা দিচ্ছি না। আমরা শুধু ব্যবহার করছি গণতান্ত্রিক স্পেসটুকু। এর কারণ হচ্ছে, এক, গণতান্ত্রিক চর্চার অংশ হিসেবে এবং দ্বিতীয়টা কৌশলগত কারণে।”

দুপুরে প্রেস ক্লাবে সমাবেশেও ফখরুল আন্দোলনের সঙ্গে কৌশলের কথা বলেছিলেন।

“একটা বড় কিছু পেতে হলে আমাদের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগোতে হবে। একটা কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা এগোচ্ছি, সেই সংগ্রাম সফল করতে হলে যে কৌশলে যেতে চাই, সেই কৌশলে সমৃদ্ধ হতে হবে।”

“পলিটিকসে আজকে যেটা হবে, কালকে সেটা হবে, এমন তো মানে নেই। আমি বলেছি যে, অবস্থার প্রেক্ষিতে পরিবর্তন তো করতে হতে পারে, সেটাই পলিটিকস। আমাদের যেটার প্রয়োজন দলের জন্য, রাজনীতির জন্য, দেশর জন্যে সেটাই আমরা করছি,” সংবাদ সম্মেলনে বলেন ফখরুল, যেখানে তার পাশে আর কেউ ছিল না।