খালেদা ‘সৎ, সাহসী সহযোগী’ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন: গয়েশ্বর

বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ‘অনেক সাফল্য’ থাকলেও তার একটি ‘ব্যর্থতা’ খুঁজে পেয়েছেন দলের স্থানীয় কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 April 2019, 02:31 PM
Updated : 19 April 2019, 02:36 PM

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন নিয়ে শুক্রবার একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তার সেই ‘ব্যর্থতা’র বিষয়টি গয়েশ্বর বলেছেন।   

তার ভাষায়, বিএনপি চেয়ারপারসন তার চারপাশে ‘সৎ ও সাহসী সহযোগী’ তৈরি করতে পারেননি, এটাই তার ‘ব্যর্থতা’।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মওদুদ আহমদ, খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের উপস্থিতিতে এ অনুষ্ঠানে গয়েশ্বর বলেন, “আজকে প্রশ্ন আসে, বেগম খালেদা জিয়া যতটুকু আপসহীন, তার দলের মধ্যে যারা… সেইভাবে তারা হয়ত আপসকামী অথবা ভীতু। অর্থাৎ কোনো ঘটনাকে মোকাবিলা করার মত সৎ সাহসের অভাব।”

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই নেতা বলেন, তাদের নেত্রীর জীবনে ‘সফলতার সার্থকতার শেষ নেই’। কিন্তু তারপরও যে এই ‘ব্যর্থতা’ রয়ে গেছে, সে কথা তিনি খালেদা জিয়াকেও বলেছিলেন।

“আমি বলেছিলাম, ম্যাডাম আপনি অল্প দিনের মধ্যে সারাদেশে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন এবং আস্থা অর্জন করছেন। নিকট ভবিষ্যতে এই আস্থা সীমান্ত ছাড়িয়ে পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে পৌঁছে যাবে। তারপরেও আপনার জীবনে যেন একটা ব্যর্থতা থেকে গেল।

“তখন তিনি রাগত স্বরে বললেন, ‘কিসের ব্যর্থতা?’, আমি বললাম রাগ করলে বলা যাবে না। আমি যা বুঝি তা আপনার শুনতে হবে।.. আপনি অনেক কিছু জয় করলেন। কিন্তু আপনার আশআশে চতুর্দিকে সিনসিয়ার অনেস্ট পরামর্শ সহায়ক শক্তি তৈরি করতে পারলেন না।

“তিনি তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে আঙ্গুল দিয়ে কপাল দেখিয়ে বললেন, ‘যা আছে তাই নিয়ে তো চলতে হবে, আমি কিই বা করব’।”

বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা ও পরামর্শকদের সামনে রেখে গয়েশ্বর বলেন, “আজো বলছি, বেগম খালেদা জিয়া ব্যর্থ; অনেস্ট, সিনসিয়ার, সাহসী সহযোগী তিনি সৃষ্টি করতে পারেননি।”

‘খালেদা জিয়া: তৃতীয় বিশ্বের কণ্ঠস্বর’ নামে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন উপলক্ষে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ‘শত নাগরিক কমিটি’।

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ও গবেষক আবদুল হাই শিকদারের সম্পাদিত এই বইটি লেখা হয়েছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ৩৬ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিয়ে।

বইয়ের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর খালেদা জিয়া কারাগারে গেলে দলে সংস্কারপন্থিদের তৎপরতার বিষয়টি স্মরণ করেন গয়েশ্বর। 

তিনি বলেন, “খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে বাদ দেওয়ার জন্য একটি সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার বাসভবনে।… তার আশপাশে বা সংস্কার প্রস্তাবের সাথে যারা জড়িত, তাদের মাতবরি দেখা গেল সেদিন।… সেটা এই গ্রন্থে উল্লেখ থাকলে মন্দ হত না “

সংস্কারপন্থিদের ওই তৎপরতার পাল্টায় বিএনপির আরেক নেতা ‘খালেদা জিয়ার ইচ্ছায়’ আরেকটি বিবৃতি দিয়েছিলেন, যেখানে বলা হয়েছিল- বিএনপি চেয়ারপারসন সংস্কারে বিশ্বাস করেন, গণতন্ত্রের বিশ্বাস করেন। দলের কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতা-কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার হবে, সেজন্য তিনি উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষার কথা বলেছেন।

“এই গ্রন্থে লেখা আছে সেই বিবৃতিটি তৎকালীন একজন যুগ্ম মহাসচিব পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সেই যুগ্ম মহাসচিবের নাই। এখন ভবিষ্যতে যদি আবুল হারিছ চৌধুরী দাবি করেন যে ‘আমি সেই যুগ্ম মহাসচিব ছিলাম’… তাই এ গ্রন্থে সত্য ইতিহাস জানতে চাইলে পাঠক বঞ্চিত হবে।”

গয়েশ্বর বলেন, সে সময় খালেদা জিয়া তার সেনানিবাসের বাসায় একপ্রকার অন্তরীণ ছিলেন। সবাই তার বাসায় যেতে পারতেন না। যারা যেতে পারতেন, তাদের কেউ কেউ হঠাৎ করে দলে বড় বড় অবস্থানে চলে গিয়েছিলেন। ওই অবস্থায় ‘দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার স্বার্থে’ মান্নান ‍ভূঁইয়ার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছিল বিএনপি চেয়ারপারসনকে।

“সরকারের সেই ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে বিদেশে পাঠানোর একটা প্রস্তুতি পর্ব শেষ হয়েছে। তিনি টেলিফোন করে কাউকে পান না, যাকে টেলিফোন করেন সে বাথরুম থেকে ফেরে না, যাকে টেলিফোন করেন, তিনি হয়ত পলাতক, যাকে টেলিফোন করেন তার কাছে থেকে উত্তর আসে সেই ব্যক্তি বিদেশে আছেন। আর কিছু লোককে টেলিফোন করা যায়নি তারা জেলখানার অন্ধকারে বন্দি।… এই অবস্থার মধ্যে খালেদা জিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি দেশ ছেড়ে যাবেন না।”

নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বিএনপি নেত্রী সে সময় নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন মন্তব্য করে গয়েশ্বর বলেন, “উনি আজকে জেলখানায়। নানা ধরনের মস্করা চলছে, ঠাট্টা চলছে, বিদ্রুপ চলছে।… এই প্যারোলে মুক্তির বিষয়টি আনতে পারে কারা? সেদিন (১/১১ সময়ে) যদি তারা মান্নান ভূঁইয়ার সাথে দলে দলে বেগম খালেদা জিয়াকে আঘাত না করত, তারা যদি চুপচাপ বসে থাকত, তাহলে সেদিন জেলখানায় যেতে হত না।”

গয়েশ্বর দাবি করেন, জরুরি অবস্থার মধ্যে দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করতে খালেদা জিয়া তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলেন সে সময়।   

“তিনি শত্রু শিবিরের মূল ব্যক্তিকে টার্গেট করেছিলেন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সঙ্গী করতে। তিনি বিদেশে শেখ হাসিনার সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছেন, দেশে ফেরত আসার জন্য বলেছেন। শেখ হাসিনা যখন দেশে আসেন, তখন তার বাসভবনে গিয়ে সহানুভূতি জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গোয়েন্দারা তাকে যেতে দেয়নি। তখন তিনি একটি অভিনন্দনপত্র শেখ হাসিনার সুধাসদনে প্রেরণ করেন। এটা রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার দুরদর্শিতা ও উদারতার প্রমাণ।”  

এমাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে এ অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন বিএনপির সহ-প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, শত নাগরিক কমিটির জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু ও জাহাঙ্গীর আলম প্রধান।

অন্যদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ারুল্লাহ চৌধুরী, ‍সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।