প্যারোল নয়, খালেদার নিঃশর্ত মুক্তি চায় বিএনপি

প্যারোল নয়, খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছে বিএনপি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 April 2019, 02:38 PM
Updated : 7 April 2019, 02:39 PM

দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “আমরা বলেছি যে, নিঃশর্তভাবে দেশনেত্রীকে মুক্তি দিতে হবে। আমরা কোনো প্যারোলের কথা বলিনি।

“আমরা খুব পরিষ্কারভাবে বলছি, জামিন পাওয়া তার অধিকার। যে মিথ্যা মামলায় তাকে জোর করে সাজা দেওয়া হয়েছে, সেই মামলায় অন্যান্য ব্যক্তিরা তারা সবাই জামিনে রয়েছেন।”

খালেদার মুক্তির জন্য আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব।

খালেদার মুক্তি দাবিতে রোববার ‘গণঅনশন’ কর্মসূচিতে মির্জা ফখরুল বলেন, “এই দেশকে বাঁচাতে হলে, মানুষকে বাঁচাতে হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে হলে দেশনেত্রীকে বাইরে নিয়ে এসে তার (খালেদা জিয়া) নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে নিয়ে আসতে হবে-এটাই হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য। আসুন আমরা সবাই এই লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হই এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করি দেশনেত্রীর মুক্তির জন্য।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন বিএনপি মহাসচিব। তার পছন্দের বিশেষায়িত বেসরকারি হাসপাতালে বিএনপি নেত্রীকে ভর্তি করার দাবি আবারও জানিয়েছেন তিনি।

রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের মঞ্চে মাদুর বিছিয়ে মির্জা ফখরুলের নেতৃত্বে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ হাজারখানেক নেতা-কর্মী সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত এই প্রতীকী অনশনে অংশ নেন।

মহানগর বিএনপি, যুব দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, ছাত্র দলসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে মুহুর্মুহু শ্লোগান দেন।

পূর্বঘোষণা অনুযায়ী সকাল ১০টায় ইনস্টিটিউশনের বাইরে এই কর্মসূচি পালনের কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পাওয়ায় আধা ঘণ্টা পরে ভেতরেই বসেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।

বিকাল সাড়ে ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমেদ বিএনপি নেতাদের পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙান।

সেখানে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে বর্তমানের গায়ের জোরের সরকার ভয় পায়, বিএনপিকে ভয় পায়, শহীদ জিয়াউর রহমানকে ভয় পায়, তারেক রহমানকে ভয় পায়। সেজন্যই আজকে বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে। মামলা কিছু নয়। যে মামলায় কারাগারে গেছে সেই মামলার সাথে তার সম্পৃক্ততা ছিল না। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ওই মামলা।”

“আজকে প্রমাণিত হয়েছে, এদেশে গণতন্ত্র দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মতোই এই সরকারের বাক্সে বন্দি, কারাগারে বন্দি। তাই আজকে আমাদের সকলের একটাই প্রত্যয় হবে, গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে হবে। গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে হলে গণতন্ত্রের মাকে আগে মুক্ত করতে হবে এবং দেশনেত্রীর নেতৃত্বেই আবার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে।”

‘গণবিচ্ছিন্ন’ সরকার খালেদা জিয়াকে ‘বেশি দিন কারাগারে আটকে রাখতে পারবে না’ মন্তব্য করে দলের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

খালেদা জিয়ার বিষয়টি অন্য নাগরিকদের মতো হলে সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে তার জামিন হত বলে মন্তব্য করেন বিএনপি নেত্রীর অন্যতম আইনজীবী ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ।

‘সরকারের কারণে’ তার জামিন হয়নি অভিযোগ করে তিনি বলেন, “আমি আইনজীবী হিসেবে বলছি, আইনি প্রক্রিয়ায় বেগম খালেদা জিয়াকে দ্রুত মুক্ত করা সম্ভবপর হবে না। আন্দোলন ছাড়া এর অন্য কোনো বিকল্প নাই। আপনারা যদি মনে করেন, বেগম জিয়াকে আমরা মুক্ত করব। এই আন্দোলনের মাধ্যমে আমি আশাবাদী, বেগম জিয়া মুক্ত হবেন এবং তিনি মুক্ত হয়ে বাংলাদেশের জনগণের নেতৃত্ব দেবেন।”

এই ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে স্লোগান দিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে না বলে মন্তব্য করেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব।

বিএনপি নেতাদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, তার মুক্তির জন্য সবাইকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়তে হবে, গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে হবে।

“আমি বলতে চাই, এক লক্ষ কর্মী জেলে আছে, ৫০ লক্ষ কর্মীর মামলা আছে। দরকার হলে আরও ৫০ লক্ষ আমরা কারাগারে যেতে রাজি আছি তাহলে খালেদা জিয়া মুক্ত হতে পারে।”

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী বলেন, “আপনারা এমনি হলের ভেতর আগামী একশ বছর গণঅনশনই বলুন আর আমরণ অনশনই বলুন করে শেখ হাসিনাকে নড়াতে পারবেন না। শেখ হাসিনাকে নড়াতে হলে উনি যা করেছেন ঠিক তেমনি করতে হবে। ভোটের কথা বলেছেন ৩০ তারিখে, ২৯ তারিখে সব ভোট উনি চুরি করেছে। তাহলে চোরকে সোজা করতে হলে আরেকটু শক্ত হতে হবে।

“আজকে গণতন্ত্র আর বেগম খালেদা জিয়া এবং ন্যায় বিচার আর খালেদা জিয়া এক হয়ে গেছে। আজকেই যদি নির্বাচন হয়, আমি তো বলতে পারি- বেগম খালেদা জিয়ার সাথে শেখ হাসিনা একটা গণভোটে আসেন তাহলে ৫ শতাংশ ভোটও আপনি পাবেন না। শেখ হাসিনা আজকে বাংলাদেশে সবচাইতে অপ্রিয় নেত্রীতে পরিণত হয়েছেন। আমি বিএনপির নেতা-কর্মীদের বলব, আপনারা হতাশ হবেন না, আপনারা ধৈর্য ধরেন।”

খালেদা জিয়ার প্যারোলে মুক্তিরও বিরোধিতা করেছেন তিনি।

“প্যারোলে মুক্তি হবে বেগম জিয়ার মৃত্যু, গণতন্ত্রের মৃত্যু। সেজন্য আপনাদের আমি বলব, আপনাদের সাথে সংহতি প্রকাশের জন্য নয়, আপনাদের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শুধু খালেদা জিয়ার মুক্তি নয়, গণতন্ত্রের মুক্তি, মানুষের মুক্তি এদেশের স্বাধীনতার মুক্তির জন্য আমি এখানে এসেছি।

“আমি বলতে চাই, খালেদা জিয়া অতি শিগগিরই মুক্তি পাবেন, তাকে জনতার আদালত মুক্তি দেবে।”

গণফোরামের সভাপতি কামাল হোসেনের বার্তা বিএনপি নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তুলে ধরে দলটির সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু বলেন, “আপনাদের মনের অবস্থা আমরা বুঝতে পারি। আমাদের দলের সভাপতি ড. কামাল হোসেন রাতে বিদেশে যাবেন চিকিৎসার জন্য। তিনি বলেছেন, আমার কথাটা পৌঁছে দেবেন।

“তিনি (কামাল হোসেন) আপনাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন এবং তিনি বলেছেন যে, এই আন্দোলনে তিনি নিজেও শরিক হয়ে কাজ করে যাবেন।”

বার্তায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে কামাল হোসেন লিখেছেন, “আজকে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে একটা কথা বলে যাই, আপনি জননেত্রী হিসেবে দাবি করেন, আপনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে দাবি করেন- আপনি গণভোট নিয়ে দেখুন শতকরা ৯৫ ভাগ লোক বেগম খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি চায়। আপনি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রাজনৈতিক পরিবারের লোক রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করুন, একটা অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মতো কেন ব্যবহার করেন। আমি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি কামনা করছি। ”

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায় মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “বেগম জিয়ার মুক্তি মানেই এদের (সরকার) বিদায়। সরকার উন্নয়নের ফানুস উড়াবে, মানুষকে স্বপ্ন দেখাবে। পদ্ম সেতু ওই রকম একটা স্বপ্নের নাম, যেটা দুঃস্বপ্ন। ঢাকা মহানগরের যতগুলো ফ্লাইওভার আছে ওইগুলো উন্নয়নের নামে মানুষের সাথে প্রতারণা। জিডিপির নামে যে কথা বলা হচ্ছে সেটা হচ্ছে ব্যাপক মানুষের সম্পত্তি লুট করা।

“এদেশে সবচাইতে বেশি ধনী বটে, সবচাইতে বেশি গরিবও বটে। দেশের কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। এক কথায় সমস্ত কিছু তুলে ধরবেন যদি বেগম জিয়া একবার বেরিয়ে আসতে পারেন।”

বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি ও সহ প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলিমের পরিচালনায় কর্মসূচিতে গণস্বাস্থ্য সংস্থার ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, বিএনপির মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, শামসুজ্জামান দুদু, আহমেদ আজম খান, আমানউল্লাহ আমান, আবদুস সালাম, হাবিবুর রহমান হাবিব, গোলাম আকবর খন্দকার, মজিবুর রহমান সারোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, কামরুজ্জামান রতন, হাবিবুল ইসলাম হাবিব, এবিএম মোশাররফ হোসেন, মাহবুবুল হক নান্নু, খন্দকার আবু আশফাকসহ কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন।

এছাড়া বক্তব্য রাখেন যুব দলের মোরতাজুল করীম বাদরু, স্বেচ্ছাসেবক দলের আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েল, মহিলা দলের হেলেন জেরিন খান, শ্রমিক দলের আনোয়ার হোসাইন, উলামা দলের শাহ মো. নেছারুল হক, নজরুল ইসলাম তালুকদার, ছাত্র দলের আকরামুল হাসানসহ অঙ্গসংগঠনের নেতারা।

অনশনে একাত্মতা প্রকাশ করেন গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের হাবিবুর রহমান তালুকদার, ২০ দলীয় জোটের শরিক খেলাফত মজলিসের অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ইসহাক, আহমেদ আবুল কাদের, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, ন্যাপ-ভাসানীর আজহারুল ইসলাম, জাগপার খন্দকার লুৎফর রহমান, আসাদুর রহমান খান আসাদ, ডেমোক্রেটিক লীগের সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি, জমিয়তে উলামা ইসলামের মাওলানা নুর হোসেইন কাশেমী, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, মুসলিম লীগের শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, বাংলাদেশ পিপলস পার্টির রিটা রহমান, পিপলস লীগের সৈয়দ মাহবুব হোসেন, বাংলাদেশ ইসলামি পার্টির আবু তাহের।

গণঅনশনে বিএনপির আবদুল আউয়াল মিন্টু, মনিরুল হক চৌধুরী, সাহিদা রফিক, সাখাওয়াত হাসান জীবন, বিলকিস জাহান শিরিন, শামা ওবায়েদ, গৌতম চক্রবর্তী, দেওয়ান মো. সালাহউদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী, আবদুস সালাম আজাদ, শামীমুর রহমান শামীম, আবদুল আউয়াল খান, মীর নেওয়াজ আলী, হারুনুর রশীদ, আমিরুজ্জামান শিমুল, খন্দকার মারুফ হোসেন, নিপুণ রায় চৌধুরী, সাইফুল আলম নিরব, শফিউল বারী বাবু, আতাউর রহমান আঙ্গুর, সেলিম রেজা হাবিব, কাজী আবুল বাশার, একে শামসুল হক, নবী উল্লাহ নবী, হাসান জাফির তুহিন, তকদির হোসেন জসিমসহ অঙ্গসংগঠনের হাজারখানেক নেতা-কর্মী অংশ নেন।    

এই কর্মসূচি উপলক্ষে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের বাইরে পুলিশ ও সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়।